১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে জয়লাভের পর পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। এখানে বিভিন্ন জাতি- ধর্ম ও বর্ণের লোকের বসবাস থাকলেও সংখ্যাধিক্যে মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রধান দুটি উসব পালিত হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একটি হলো ঈদুল ফিতর এবং অপরটি ঈদুল আজহা বা কোরবানীর ঈদ। পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখা দেওয়ার পরর হতে ১ মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রমজান মাস অতিবাহিত হবার পর শাওয়াল মাসে পশ্চিমাকাশে এক ফালি চাঁদ উদয় হওয়ার পরদিন মহা ধুম ধামের সাথে পালিত হয় ঈদুল ফিতর।
অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও মুসলমানদের প্রধান ২টি ধর্মীয় উৎসব পালন করতে গিয়ে অজাচিত ও অপ্রত্যাশিতভাবে বাধার মুখে পড়তে হয়। তাহলো বিশ^জুড়ে মহামারি করোনাভাইরাস। বৈশি^ক করোনাভাইরাসের সংক্রমণে লাখো লাখো মানুষ অকাতরে তাদের অমূল্য জীবন বিসর্জন দিয়ে চলেছে। বিশে^র ২১৪ দেশ ও অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা ইতোমধ্যেই কোটির ঘর ছাড়িয়ে গেছে। বলতে গেলে সারা বিশ^বাসীই আজ আতঙ্কগ্রস্থ। জীবনাবসানের অনাকাঙ্খিত এই মহড়ায় কে কখন শামিল হয়ে পরপারে যাত্রা করে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। এই অদৃশ্য শক্তিধর মহামারির কাছে আজ বিশ^বাসী যেন জিম্মি। কোন দেশই এপর্যন্ত এই মরণব্যাধির কার্যকর কোন ওষুধ আবিষ্কার করতে পারেনি। প্রাণের চেয়েও প্রিয় ব্যক্তি, আত্মীয়, অনাত্মীয় পরিচিত- অপরিচিত মানুষজন করোনার কাছে নতি স্বীকার করে ইহলোক ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। একের পর এক মৃত্যুর মিছিলে গিয়ে শামিল হচ্ছে। এর কোন প্রতিকার নেই নেই প্রেিরাধের কার্যকর ব্যবস্থা।
এমনি অবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরকে পিছনে ফেলে এসেছে। আর সে থেকেই এদেশের মানুষ বেশি বেশি সংক্রমিত হচ্ছে। সেসময় অর্থাৎ গত ২৫ মে তারিখে অনুষ্ঠিত ঈদুল ফিতরের দিন করোনায় মৃতের সংখ্যা ছিলো ৫০১ জন। সনাক্তের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৫৮৫ জন। বর্তমানে মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজারের ২৩৮ জন। আক্রান্ত সংখ্যা পৌনে ২ লাখের উপর। সুস্থ্য হয়েছে মাত্র সাড়ে ৮৫ হাজার। রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে ঈদুল ফিতর উদযাপনের জন্য মানুষজন একস্থান হতে আরেক স্থানে যাতায়াতের কারণেই এই রোগ সমগ্র বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করে চলেছে। তার আগে সারা দেশে লকডাউন ঘোষণাসহ সরকার কর্তৃক সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা ছিলো। মানুষজনের অবাধ চলাফেরার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপিত ছিলো। সারা দেশের দোকানপাট বন্ধ। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ছিলো বেশ তৎপর। তখন এমন কড়াকড়ি আইন বলবৎ ছিলো যে, মানুষ এক জায়গা হতে আরেক জায়গায় যেতে চাইলে তাকে রীতিমত কৈফিয়ত দিতে হতো। গত ২১ মে তারিখে দৈনিক কালের কন্ঠ এবং ফেসবুকে প্রচার করা হয় যে, রাজধানী ঢাকা থেকে কাউকে ঢাকার বাইরে যেতে হলে পুলিশ পাস নিয়ে যেতে হবে। তখন পুলিশের পক্ষ হতে বলা হয়েছিলো যে, ঢাকা থেকে বের হতে এবং ঢাকাতে ঢুকতে হলে মুভমেন্ট পাস লাগবে। পাশের জন্য অনলাইনে আবেদনের একটি ছকও দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু কি করতে কি হয়ে গেলো সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেলো। বলা হয়েছিলো স্বাস্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সাথে সম্বয়হীনতার কারণেই নাকি এমনটি ঘটেছিলো।
ঈদের ছুটিতে আন্ত:জেলা যাতায়াতের সুযোগ দেওয়ার কারণে যে পরিমান মানুষ পেশি শক্তি খাটিয়ে ঠেলা-ঠেলি, ধাক্কা-ধাক্কি করে পবিত্র ঈদুল ফিতরের ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে গমণ এবং ঈদ শেষে পুণরায় একইভাবে রাজধাণী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে স্ব স্ব কর্মস্থলে প্রত্যাবর্তন করলো তাতে কোরানাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য বেশি পেরেশান হতে হয়নি। অনয়াসেই রোগির সংখ্যা আনুপাতিকহারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। সেসময়বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা সংশ্লিষ্ট সকলকে শতর্ক করে বলেছিলো, করোনার প্রথম ঢেউ থাকতে থাকতেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের বড় আঘাত আসতে পারে। সত্যি সত্যিই দ্বিতীয় ঢেউ এর আগমণ শুরু হলো যা এখনো চলছে।
এরই মাঝে অতি সন্নিকটে হাজির হচ্ছে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা বা কোরবানীর ঈদ। এবারেও যদি একই অবস্থার অবতারনা করা হয় তাহলে ‘‘ উত্তপ্ত কড়াই খেকে জ¦লন্ত চুলায় পড়ার মত অবস্থা হবেনাতো? ’’
আসন্ন ঈদুল আজহায় ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত বিশেষ করে পশুর হাটকে ঘিরে করোনাভাইরাস (কোভিড- ১৯) মহামারি পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির আশঙ্কা করছেন জনপ্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে ঈদে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানান তারা। করোনাকালীন সংকট নিয়ে বিশেষ ওয়েবিনার ‘ বিয়ন্ড দ্য প্যানডেমিক’-এর সপ্তম পর্বে ‘জনস্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারি জনপ্রতিনিধিরা এ আহ্বান জানান। গত ২৭ জুন-২০২০, রাতে আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রির্সাচ এন্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) আয়েজিত এই আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি ব্যারিষ্টার শাহ আলী ফরহাদের সঞ্চালনায় এতে আলোচক হিসেবে ছিলেন, স্থানীয় সরকার পল্লীউন্নয়ন ও সমবায় ( এলজিআরডি) মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিষ্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান (লিটন), নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভি, ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু।আসন্ন কোরবানীর ঈদকে ঘিরে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাকতে সরকার কাজ করছে জানিয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন,‘‘কি করা যায় তার জন্য আমরা প্রাথমিক মিটিং করেছি।এটা শেষ মিটিং নয়। ঈদের আগে আরো মিটিং হবে, সেখানে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। তিনি বলেন, পশুর হাট খন্ড খন্ড হবে নাকি এক জায়গায় হবে এ নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। একটা ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্রে আমরা একটা করি তাহলে সমস্ত ইউনিয়নের মানুষ হয়তো এখানে আসবে। আসলে সেখানে বেশি গণজমায়েত হবে। সেটা না করে যদি খন্ড খন্ড করে করলে গণ জমায়ত কম হয় হতাহলে সেটাই করা হবে। প্রতিটি গ্রামের পাশে ছোট ছোট জায়গা করে করতে পারি তাহলে গণজমায়েত হবেনা। মানুষকে সচেতন করতে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন তৈরি করা হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন,আমরা একটা টিভিসি তৈরি করছি। অলরেডি সেটা আন্ডার প্রোডাকশন। টিভিসিটা মানুষকে সচেতন করার জন্য অর্থাৎ গরু আপনি কিভাবে কিনবেন? কিভাবে কোরবানী করবেন, কিভাবে জনসমাগমে না গিয়ে নিজেকে সংক্রমণ থেকে কিভাবে রক্ষা করবেন তার পরিষ্কার ধারণা রয়েছে এতে। এই আলোচনাসভায় গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।’’ ( বাংলাদেশ সময়-২৮ জুন-২০২০)।
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।