মহামারি রোগের আঁতুড় ঘর চীন হতে ইঁদুরের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়ে জাহাজ যোগে তা বোম্বে বন্দরে পৌঁছে। ১৮৯৬ সালে বোম্বে পৌঁছার পর হতে ভারতীয়রা পর্যায়ক্রমে আক্রান্ত হতে থাকে। তখন থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে শুধু ভারতেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলো অন্তত ১ কোটি মানুষ। রোগ সংক্রমণের প্রথম বছরে তৎকালীন বোম্বে শহরে মানুষের মৃত্যুর হার ছিলো সপ্তাহে প্রায় ১ হাজার ৯ শ। পরে তা ছড়ায় কলকাতা, করাচি ও অন্যত্র। ভারত বাদে চীনের এই প্লেগ রোগে দুনিয়ার সব দেশ মিলিয়ে মৃত্যু হয়েছিলো ৩০ লাখ মানুষের। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯৭ সালে তাড়াহুড়ো করে দুর্দম এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট অব ১৮৯৭ পাশ করা হয়। এতে শাসক ও প্রশাসনিক কর্তাদের দেওয়া হলো কার্যত অবাধ স্বাধীনতা। এখনকার কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে , তেমনি সামজিক দুরত্ব ও সঙ্গরোধ জাতীয় আইন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সিন্ধিয়া দেশ মুখ-এর দ্য বম্বে প্লেগ (১৮৯৬-৯৭) রচনায় দেখা যায়, জৈন, ভাটিয়া এবং বনিয়ারা, যারা মান্ডি এলাকার ‘চাল’ বা ঘনবসতির সস্তার দালানে থাকতেন, ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে ইঁদুর মারতে বাধা দিয়েছিলেন তারা। ১৮৯৭ সালের ২২ জুন দমনপীড়নের প্রতিবাদে চাপারকার ভাইদের বন্দুকের গুলিতে প্রাণ দেন প্লেগ কমিশনার রান্ড। আজকের এই অতিমারি – বিধ্বস্ত সময়ে দাঁড়িয়ে সোয়া শতক আগেকার অবস্থার সঙ্গে অনেক রকম মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, এই কথাটা কিন্তু আশ^স্ত হওয়ার মত নয়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৯১০ সালে সবচেয়ে বড় প্লেগ মহামারি দেখা দেয়। সেসময় চীনের মাঞ্চুরিয়ায় দুই বছরে মারা যায় প্রায় ৬০ হাজর মানুষ। চীনকে করোনাভাইরাসের আঁতুড় ঘর এইজন্য বলা হয় যে, বৈশি^ক বেশিরভাগ রোগেরই সুতিকাগার চীন। ডেঙ্গু নামক ব্যাধিটির উৎপত্তিও চীনে। এই রোগের প্রথম উল্লেখ রয়েছে চীনের নথিপত্রে। বিবিসি বাংলা বিভাগ জানায় চীনে এই রোগটি ৯৯২ খ্রিস্টাব্দে চীনে প্রথম সনাক্ত করা হয়েছিলো।
পাবনা জেলার গ্রামীন জনপদে আজো একটি বাক্য চালু আছে, তাহলো ‘‘ যেখানে ঝয়-ঝামেলা, সেখানেই তোছে।’’ অর্থাৎ যেখানে ঝামেলা সেখানেই তছিমুদ্দিন ওরফে তোছে গিয়ে হাজির হয়।’ চীনের অবস্থা হয়েছে তাই। সারা বিশে^ এযাবৎ যত মহামারির আবির্ভাব ঘটেছে তার বেশিরভাগই উৎপত্তিস্থল চীনে। সারা বিশ^ব্যাপি মহামারি কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস তাই বার বার চীনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কন্ঠশিল্পী মৃত্যুঞ্জয় নাগ গেয়েছেন, এমন ব্যাধি দিলো চীনা/ দাওয়াই দিলোনা/মরণের আরেক নাম হলো করোনা/ এলো করোনা / মেড ইন চায়না।… বাাঁচবো কি মরবো মোরা কেউতো জানিনা……….।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো কোভিড-১৯ সুতিকাগার বা আঁতুড় ঘরকে বারবার দোষারোপ করে চলেছে। তারা বলছে চীনের ল্যাবরেটরি থেকে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। আর সেই তথ্য লুকাচ্ছে চীন। তবে বেইজিং এর পক্ষ থেকে দাবি অস্বীকার করা হলেও প্রায় ১ বছর আগে এই ভাইরাস নিয়ে আশ্কংা প্রকাশ করেছিলেন ‘ব্যাট ওম্যান’ নামে পরিচিত উহানের ওই ল্যাবরেটরির এক গবেষক্।
উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির অন্যতম প্রধান গবেষক শি ঝেংলি এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। ১১ মাস আগে সতর্ক করেছিলেন তিনি। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, এই ভাইরাস মহামারির আকার নিতে পারে। শি ও তার টিম বাদুড় থেকে আসা এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। উহানের ওই ল্যাবেই গবেষণা চলছিলো। বাদুড়ের এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি ‘ব্যাট ওম্যান’ হিসেবেও পরিচিত। জানা যায় এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার তিন দিনের মাথাতেই নতুন করোনাভাইরাসের জিন নিয়ে তথ্য সামনে এনেছিলেন এই নারী গবেষক। কিন্তু তার উপদেষ্টারা তাকে চুপ করিয়ে রাখেন।
ইনস্টিটিউিট অব ভাইরোলজির ডেপুটি ডিরেক্টর শি ও আরো তিন গবেষক মিলে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন। মার্চ মাসে সেই গবেষণাপত্র প্রকাশ্যে আসে। সেখানেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিলো যে, সার্স, মার্স ও সোয়াইনের পর ফের করোনাভাইরাস মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। ওই তিনটি রোগই হয়েছিলো করোনাভাইরাস সম্পর্কিত, যা বাদু–ড় থেকে আসে। আর এর মধ্যে দুটিই চীন থেকে ছড়িয়েছিলো। ওই গবেষক লিখেছিলেন, সার্স কিংবা মার্সের মত করোনাভাইরাস ফের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। আর চীন থেকেই তা ছড়ানোর আশঙ্কা সব থেকে বেশি। তিনি আরো বলেছিলেন, গোড়া থেকেই সতর্কতা নেওয়া হলে সংক্রমণ কমানো যেতে পারে। ওই গবেষণা পত্রে লেখাছিলো, চীনারা তাজা মাংসই সবচেয়ে বেশি পুষ্টিকর মনে করেন। আর এই খ্যাদ্যভাসই সংক্রমণের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
রয়টার্স,টেলিগ্রাফ অনলাইন ডেস্ক হতে জানা যায়, ‘ দুনিয়াজুড়ে করোনাভাইরাসের মধ্যেই চীনে ফের শুরু হয়েছে কুকুর খাওয়া উৎসব। গত ২১ জুন শুরু হওয়া এ উৎসব চলবে ৩০ জুন পর্যন্ত। এই আয়েজনে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। চীনে পশুদের নিয়ে কাজ করা হিউম্যান সোসাইটি ইন্টারন্যাশনালের মুখপাত্র পিটার লি বলেন, চীনে প্রতি বছর ১ কোটি কুকুর ও ৪০ লাখ বিড়াল মারা হয় ব্যবসার জন্য।’ মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের দাবি , উহানের ওই ল্যাবরেটরি থেকেই লিক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাস। উহানের মাছের বাজারের সঙ্গে ভাইরাসের কোন সম্পর্ক নেই বলেই মনে করছে বহু বিশেষজ্ঞ। আমেরিকা এই বিষয়ে রীতিমত তদন্ত শুরু করেছে। মার্কিন সচিব মাইক পম্পেও জানিয়েছেন, কিভাবে গোটা বিশে^ এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লো তার নিখুঁত তদন্ত করবে আমেরিকা। চীনের ভাইরাস কালচার কালেকশনের কেন্দ্র এই গবেষণাগার। বলা যেতে পারে এটাই এশিয়ার বৃহত্তম ভাইরাস ব্যাংক। যেখানে ১৫০০ ধরণের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চলছে। যেসব ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারে , সেই রকম ভাইরাস রয়েছে এই গবেষণাগারে।
করোনাভাইরসের আঁতুড় ঘর চীনে আরো ভয়ঙ্কর হানা দিবে এই করোনাভাইরাস। করোনাভাইরস সংক্রমণ পরিস্থিতি যেদিকে এগুচ্ছে, তাতে অচিরেই অতিক্রম হতে পারে ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির রেকর্ড, যাতে বিশ^ জুড়ে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি লোক মৃত্যুবরণ করেছিলো। শুধু তাই নয়, রোগ-ব্যাধির আঁতুড় ঘর হিসেবে খ্যাত চীনের হংকং থেকে ১৯৫৭ সালে এশিয়ান ফ্লু নামে একটি মরণব্যাধি চীনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পরে তা ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে যুক্ত রাজ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। একারণে প্রায় ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৫৮ সালের শুরুর দিকে এশিয়ান ফ্লু দ্বিতীয়বারের মত মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় এশিয়ান ফ্লুতে বিশ^ব্যাপি প্রায় ১১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মারা গিয়েছিলো ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষ। চীনা করোনাভাইরাসকে আমেরিকার পেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম তাই নাম দিয়েছেন ‘‘ কুং ফ্লু।’’ )। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।