— এবাদত আলী
স্পেনে কর্মরত ইতালীয় নাগরিক ক্রিষ্টোফার কলম্বাস কর্তৃক ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকা নামে একটি দেশ আবিষ্কার করা হয়। বিশ্বের ধনতান্ত্রিক দেশ গুলোর মধ্যে অন্যতম এই আমেরিকায় ১৮৬১ সালের দিকে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। আমেরিকার উত্তরের ১১টি রাজ্যের সাথে দক্ষিনের যে রাজ্য গুলোর সংঘাত দেখা দেয় তা ইউনিয়ন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের নেতৃত্বে উত্তরের রাজ্যগুলো ইউনিয়ন রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। ফলে যুদ্ধে উত্তরের রাজ্যগুলো জয়ী হয়। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। গড়ে ওঠে অগণিত কল কারখানা। ধণিক শ্রেণির লোকদের কারখানায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত লোকেরা শ্রম দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে।
শ্রমিক এবং কারখানা একে অপরের পরিপূরক হলেও কারখানার মালিকগণ শ্রমিকদের প্রতি সব সময়ই ছিল উদাসীন। সমস্ত দিন রাতের মধ্যে কোথাও বা ২০ ঘন্টা একটানা শ্রম দিতে হত তখনকার শ্রমিক সমাজকে।
ইউনিফর্ম পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কোমল প্রাণ যে শিশুর স্কুলে যাবার কথা, বিত্তবানের কারখানায় বিরামহীন শ্রমে সেই শিশুটিই গনগনে চুল্লির পাশে চরম ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ত। মালিকদের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির বাহন হিসাবে শ্রমিকদের জন্য রাত দিনের কোন বাচ বিচার ছিলনা। শোষণ ও যন্ত্রনার সে এক অসহনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। অথচ তারা প্রতিবাদ করতে পারতনা। কোথাও যদি কোন শ্রমিক ভুলক্রমে ক্ষীণতম প্রতিবাদ জানাত, তাহলে তাদের উপর চলত অকথ্য নির্যাতন। তাদের শরীর প্রহারের আঘাতে জর্জরিত হয়ে উঠতো।
তখনকার দিনে এ ঘটনা শুধু আমেরিকাতে নয়, শ্রমিক নির্যাতন চলছিল সারা দুনিয়া জুড়ে। শ্রমিকদের প্রতি মানবিক আচার আচরণ প্রদর্শন তথা তাদের প্রয়োজনীয় আরাম আয়েস আর নিরাপত্তার প্রতি মালিক পক্ষ ছিল সম্পূর্ণ উদাসিন।
শ্রমিক শোষণের এ হেন পরিস্থিতির মাঝেই অন্যায় ও মানবিক কালো নীতি দুর করতে শ্রমিক সমাজ তাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকে। এ দিকে ফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হয়। সংঘটিত হয় জার্মানীতে বিপ্লব। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল শ্রমিক শ্রেণির মানুষের অবাধ অংশগ্রহণ।
১৮৬৪ সালে শ্রমিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমজীবী মানুষ এই প্রথম একটি শ্রেণি হিসাবে আদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে ওঠে। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে পেরী কমিউনের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির প্রথম ক্ষমতা দখল অত:পর লাখ লাখ শ্রমিকের আত্মত্যাগ ও দেশান্তরি হওয়ার মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের বিপ্লবী চেতনা শানিত হয়ে ওঠে। শ্রমজীবী মানুষের রক্তাক্ত সংগ্রামের ধারায় আমেরিকায় শ্রমিক শ্রেণি সংগঠিত হয় এবং সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
প্যারী কমিউনের পর আমেরিকার শিকাগো শহরেই সবচেয়ে বিশাল শ্রমিক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এই আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আন্দোলন না হলেও শ্রমিকরা তাদের দাসত্বের শৃংখলে আঘাত করতে সক্ষম হয় এবং শ্রমজীবী মানুষ যে পুঁজির দাস নয় তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
শ্রমিক শোষনের অমানবিক দিক তুলে ধরে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে মার্কিন মূলুকের গোটা শ্রমিক সমাজ সোচ্চার হয়ে ওঠে। দিন ও রাতের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৮ ঘন্টা কাজ ৮ ঘন্টা বিশ্রাম ৮ ঘন্টা বিনোদন এই দাবি ওঠে পুঁজিবাদি আমেরিকাসহ গোটা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের দাবি। তাদের এই ন্যায় সঙ্গত দাবির সবচেয়ে সরব ও জঙ্গি প্রকাশ ঘটে ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের পয়লা মে এবং পরবর্তী কয়েক দিনের ঘটনা ছিল অত্যন্ত দুঃখ জনক।
মে মাসের চার তারিখে শিকাগো শহরের ‘ হে’ মার্কেটের এক সমাবেশে শ্রমিক-পুলিশের সংঘর্ষে ৪ জন শ্রমিক নিহত হয়। পুলিশ মারা যায় ৭ জন। অনেক শ্রমিক আহত হয়। আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারি শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। তারপর বিচারের নামে শুরুহয় প্রহসন। অজুত শ্রমিকের মিলিত কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার ঘৃন্য ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে শোষক ও তার দালাল গোষ্ঠি।
প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ নভেম্বর ফাঁসিতে ঝুলানো হয় শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারি নেতা পারমনস, ফিশার ও এঙ্গেলকে। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এক শ্রমিক নেতা উচ্চকন্ঠে বলেছিলেন, “সক্রেটিস, খ্রিষ্ট, গিয়েদানোব্র“নো, গ্যালিলিউকে সত্য বলার কারণে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছিল, আমরা সেই ঐতিহ্যের অনুসারি”। পরমনসের শেষ প্রার্থণা ছিল “ হে আমেরিকার মানুষ আমাকে বলার অনুমতি দেওয়া হবে কী ? শেরিফ ম্যাটসন আমাকে বলতে দিন। জনগণের কন্ঠস্বর শোনা হোক।” তার কোন কথা শোনা হয়নি। বলতে দেয়া হয়নি কোন কিছুই। ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পুর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন‘‘ আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অনেক শক্তিশালী।’’
অন্যান্য আটককৃতদের মধ্যে গীরসোয়ার ও ফিলডেনকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ডাদেশ প্রদান করা হয়। জেলের অভ্যন্তরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় শ্রমিক নেতা লীগনকে।
পৃথিবীর শ্রমিক সংগ্রামের ইতিহাসে লেখা হয় ‘হে মার্কেট ম্যাসাকার’ নামে।
এরপর আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবারের সম্মেলনে এবং প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে ১৮৯০ খিষ্টাব্দের ১ মে থেকে এই তারিখটিকে দুনিয়া জুড়ে শ্রমজীবী মানুষের মৈত্রি, সংহতি ও অধিকারের দিন হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সেই থেকে আমেরিকার শিকাগোর রাজপথে শ্রমজীবী মানুষের বুকের রক্তে রঞ্জিত স্মৃতি মনে রেখে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই পালিত হয়ে আসছে অজুত শ্রমিকের রক্তে রাঙানো মহান মে দিবস। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
প্রেরক: এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য, পাবনা প্রেসক্লাব । তারিখ: ৩০/০৪/২০২৫.
