সাংবাদিকতার সাড়ে তিন যুগ

(পূর্ব প্রকাশের পর)
(ষোল)
১৯৭৮ সালের ৭ মে পাবনা জেলার আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠন করা হয় মাত্র ছয়/সাত জন সাংবাদিককে নিয়ে। আমাকে সভাপতি, আবদুস সাত্তার মিয়াকে সম্পাদক এবং আমিরুল ইসলাম রাঙা, হাসান আলী, এস দাহার মাতলু ও মোহাম্মদ ইয়াছিনকে সদস্য করে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের যাত্রা শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তারও কম। এসময় আরেকজন সাংবাদিককে সদস্য পদ প্রদান করা হলো। তিনি হলেন দৈনিক উত্তর দেশের পাবনা জেলা প্রতিনিধি এইচ কে এম আবু বকর সিদ্দিক।
আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের এই সকল সাংবাদিকের মধ্যে একমাত্র আমিই তখন কলাম লিখতাম। যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্ফুলিঙ্গ পত্রিকায় যা নিয়মিতভাবে প্রকাশ হতো। সপ্রতিভের কলাম নামে একটি কলামে “তিন আলেমের কিচ্ছা” প্রকাশিত হয় ১৯ জুলাই/১৯৮০ সালে। সন্মানিত পাঠকদের সমীপে তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।

উভয়পক্ষের ঠোকাঠুকির ফলে বাড়িওয়ালা নেহায়েতই বোকা বনে গিয়ে রীতিমত ভড়কে গিয়েছিলেন প্রথম দিকে। ষাট-বাষট্টি টাকার বিনিময়ে মাইক ভাড়া করে ধামা ভর্তি হালুয়া রুটি এবং তার সাথে তাগড়া তাগড়া গোটা কয়েক মোরগ-মুরগি জবাই করে সব বুঝি ভেস্তে যাবার উপক্রম। না কোন নাবালেগ পোলাপানের আকিকা, যৌবন ছুঁই ছুঁই করা পুত্রের খাতনার পাক গোসলের দিনে বাজিমাৎ করা রেকর্ড বাজিয়ে ধুমধাম করার জন্য নয়। আসলে তার উদ্দেশ্য কিছু ওয়াজ-নছিহত শোনা। তাই পবিত্র সবে বরাত উপলক্ষে বাড়িওয়ালার এরাদা ছিলো বিজ্ঞ আলেম ওলামাকে দাওয়াত করে নিজ বাড়িতে এনে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া কালমা পড়িয়ে নিজেও সোয়াব হাছিল করবেন এবং সেই সঙ্গে মৃত মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনের জন্য দোয়া খায়ের করবেন। উপরন্ত মাইকে জোরে শোরে ওয়াজ-নছিহত হবে, দুচার গাঁয়ের লোকজন জানবে ওমুকের বাড়িতে পবিত্র সবে বরাত পালিত হচ্ছে।
যথসময়ে মাগরিবের আজানের পূর্বে লম্বা একটা শুকনো বাঁশের মাথায় মাইকের হর্ন বাঁধা হলো। খটখট ঘটঘট হ্যালো হ্যালো ক্যাঁ কু্যঁ ইত্যাদি আওয়াজ ও স্বরে মাইকের অপারেটর কর্তৃক মাইক সেট করা হলো। স্থানীয় মক্তবে পড়া দুচারজন ছেলে-মেয়ে কম্পিত কন্ঠে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও গজল পাঠ করলো। কিন্তু গোল বাধলো একটি ব্যাপার নিয়ে। বাড়িওয়ালা দাওয়াত করেছেন পরপর তিনজন আলেমকে। তার মধ্যে প্রথম যিনি এসেছিলেন তিনি তরিকা ভুক্ত আলেম। বাকি দুজন ওসব তরিকা টরিকা মানতে নারাজ। কিন্তু প্রথম যিনি এসেছিলেন তিনি লাউডস্পিকার হাতে নিয়ে গজল শুরু করলেন। আল্লাহর প্রেমের আশেক দল আল্লাহু আল্লাহু বল। আল্লাহর নামে এতই মধু জানে শহীদ কারবালা, পানি বিনে ধুকে মরে নয়নমনি ফাতেমার। সেই দৃশ্য দেখে আসে ফেরেস্তাদের চোখে জল, আল্লাহু আল্লাহু বল।
অপর দুজন আলেম তখন উসখুস করে বাড়িওয়ালাকে ডেকে বললেন তরিকাভুক্ত লোককে দাওয়াত করা হয়েছে সেখানে আমাদেরকে দাওয়াত না করলেইতো পারতেন। বাড়িওয়ালাতো অবাক। তিনি এতসব সাত-পাঁচ বুঝতে পারছেননা। তাই তিনি বিনীতভাবে বলেন, উনার ওয়াজ শেষ করলেই আপনারা ওয়াজ করবেন। বাড়ি–য়ালার কথায় তারা আপাততঃ শান্ত হলেন।
এরপর যথারীতি মাগরিবের নামাজ আদায় করা হলো। কিন্তু প্রথম বক্তা আবার মাইক হাতে নিয়ে জেকেরের বয়ান শুরু করে দিলেন। তার আগে কিছু কথা বলে নিলেনযেমন; আপনারা সকলেই (ঐ মজলিসে যারা উপস্থিত ছিলেন) আপন আপন চক্ষু বন্ধ করে ক্বালবের মাঝে ডুবে যান। ক্বালবের মাঝে ডুবে গিয়ে আপন পীরের কদম মোবারক দেলের হাত দিয়ে জড়ায়ে ধরেন। জডায়ে ধরে আজিজি করতে থাকেন। তিনি আপন আপন নেজবতের পীরের কদম মোবারক জড়িয়ে ধরার কথা বলেই জেকের শুরু করে দিলেন। উপস্থিত মুসুল্লীগণ সকলেই জেকেরে শরিক হলেন।
এক সময় জেকের শেষ হলো। সকলেই কিছু সময় বিশ্রাম নিলেন। এরপর দ্বিতীয় আলেম সাহেবের ওয়াজের পালা। তিনি নাহমাদুহু ওয়া নুছাল্লী আলা রাছুলুহুল কারিম বলে একটু কেশে নিয়ে ওয়াজ শুরু করলেন। (ক্রমশঃ)। (লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট)।