আলাউদ্দিন আহমেদ
পদ-পদবি কেন এতো লোভনীয় হয়ে উঠছে-? সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র এখন চেয়ারে বসা নিয়ে
সামঞ্জস্যহীন প্রতিযোগিতা চলছে। ভাবটা এমন যে, সুবিধাজনক একটা চেয়ার পাওয়াই তার
জীবনের স্বপ্ন। রাজনীতির মাঠে এখন একটি বড় অংশই অতি আগ্রহি যেকোনভাবে একটা
চেয়ারে আসীন হতে। কিন্তু রাজনীতির লক্ষ্য কি শুধুই চেয়ার নাকি জনগনের প্রকৃত মুক্তির
লড়াইয়ের একজন যোদ্ধা হিসেবে প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়োজিত রাখা-?
শুধু রাজনীতি নয় সামাজিক. সাংস্কৃতিক. ক্রীড়া. ব্যবসা. শিক্ষা. মসজিদ কমিটি সহ সকল
ক্ষেত্রে কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে অবস্থান নিতে রীতিমত অশুভ প্রতিযোগিতাসহ হানাহানির
ঘটনাও কম ঘটেনা। কেন এতো আকর্ষন চেয়ার. পদ-পদবির প্রতি-!
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি-বেসরকারি অনেক ভারি ভারি চেয়ার দখলকারি (যেহেতু এরা উপযুক্ত নয়)
তাদের লাগামছাড়া অপকর্মের কারনে ধরা পড়ছে, জনগনের সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচিত
হয়েছে, হচ্ছে। যারা ধরা পড়ছে তারা অপকর্মকারীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আড়ালের কুশিলবরা
লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে। এরা অনেকেই বেঁচে যাচ্ছে অবৈধ অর্থের জোরেই। একটা
কথা প্রচলিত আছে, আমাদের দেশ নাকি সব সম্ভবের দেশ।
একটি মজবুত চেয়ারে অবস্থান থাকলে নিজেকে তেমন কিছু করতে হয়না। এদিক-ওদিকের আয়
রোজগার করা লোকজন নাকি নিয়ম অনুসরণ করে তাদের কাছে সময়মত খাম পৌছে দেয়। খামের
ব্যাখ্যা দেয়ার নিশ্চয় প্রয়োজন নেই। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশের রাজনীতির ক্ষমতা
নিয়ন্ত্রনকারি বড় দলগুলো দুর্নীতিকে জীবনের স্বাভাবিক একটি অংশে পরিনত করেছে। অবৈধ
অর্থ উপার্জনে তেমন কোন রাখঢাক নেই। বাড়ির গৃহিনি এমনকি ছেলেমেয়েরাও জানে এতো
টাকা তাদের অভিভাবকরা কিভাবে উপার্জন করে। এদের নিজেদের বিবেকও সেইভাবেই এইসব
অপকর্মের সাথে স্বাভাবিক করে ফেলা হয়েছে।
আমাদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করেছিলেন।
তাঁর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে এর স্পষ্ট ঈঙ্গিত পাওয়া যায়। একশ্রেনীর আমলা ও দলীয় নেতাদের
অপকর্মের বিরুদ্ধে তিনি বারবার সতর্ক করেও বন্ধ করতে পারেননি। এ ব্যাপারে তিনি ক্ষোভ
প্রকাশের সাথে সাথে আপসোসও করেছেন। আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরে থাকা বড় ব্যবসায়ীদের লোভ-
লালসা সম্পর্কে তিনি পার্লামেন্টেও একাধিকবার বক্তব্য রেখেছিলেন। দীর্ঘদিন পর এখনো সেই
পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁরই কন্যা আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ
হাসিনা। এখনকার এই লড়াইটি ওই সময়ের চেয়ে আরো বেশি কঠিন। কারন দুর্নীতি ও
অপকর্মকারীরা এখন ধনসম্পদে অনেক বেশি শক্তিশালী। স্বাভাবিক কারনে এরা তাদের অস্তিত্ব
বাঁচাতে ষড়যন্ত্র করবে, বাধাগ্রস্থ করবে আলোচিত শুদ্ধি অভিযানে। এরপরও এই লড়াইয়ে হেরে
গেলে সর্বনাশের আর শেষ থাকবেনা।
কেন ওই অপকর্মকারীরা ভয়শূন্যভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলছে। কে বা
কোন সিস্টেম তাদেরকে প্রোটেকশন দিচ্ছে। এটাই হচ্ছে সেই লোভনীয় চেয়ার. পদ-পদবি। সব
মিলিয়ে ‘চেয়ারের ক্ষমতা’। অবশ্য এটা প্রকৃত ক্ষমতা নয়। এটাকে বলে চেয়ারের অপব্যবহারের
ক্ষমতা। কারন আমাদের পবিত্র সংবিধান কোন রকম দুর্নীতি বা অপকর্ম করার অনুমোদন দেয়নি।
লুটেরাদের জন্য সমাজ নয়। সমাজ হতে হবে ভাল মানুষদের জন্য। অপকর্মকারীরা চলবে মাথা নিচু
করে, ভাল মানুষরা চলবে মাথা উঁচু করে। আমরা এই পরিবেশ চাই। এটা করতে হলে অপরাধীদের
ভয়শূন্যতা কাটাতে হবে। কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সকল অপকর্মকারীর শেকড় তুলতে হবে।
‘খাম পাওয়া’ গডফাদারদের জনগনের সামনে প্রকাশ করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর লেখায় বলেছেন; ‘রাজনীতি হতে হবে
ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে। দেশকে আমরা কি দিতে পারলাম সেটাই একজন রাজনীতিবিদের চিন্তা-
ভাবনা হতে হবে । দেশ কি দিল তা বড় কথা নয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম
সেটাই বড় কথা’। (সুত্র: শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র ১, পৃষ্ঠা ২১৩)। কিন্তু তাঁর এই কথাগুলো
দলের সুবিধাভোগীরা কি আদৌ আমলে নেয়-?
বিশ^জুড়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলে এখন ভোগবিলাসী মানসিকতায় আক্রান্ত
হয়েছে একশ্রেনীর মানুষ। এরা যেকোন কায়দায় শুধু ধনসম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতায় মেতে
উঠেছে। এই শ্রেনীর ধান্দাবাজরা রাজনীতির নামে দলের ছত্রচ্ছায়ায় চলে। ফলে এরাই চেয়ার. পদ-
পদবির জন্য অর্থব্যয়সহ প্রতিযোগিতার নামে দলাদলি. হানাহানিতে লিপ্ত হয়। এদের দাপটে
প্রকৃত যারা দলপ্রেমি. মানবপ্রেমি. দেশপ্রেমি তারা ক্রমান্বয়ে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে।
মাঠ পর্যায়েও দেখা যায়, যারা এক সময় পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করতেন অথবা সমাজের অন্য সেক্টরের
যারা দু’একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তাদেরকেই অবমূল্যায়ন করেছে ওই ধান্দাবাজরা। তাদের
নামে বদনাম রটানোর চেষ্টা করেছে। কারন তারা চায়না স্বচ্ছ মানুষরা আর কোথাও কোন
নেতৃত্বে থাকুক। এরা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে বুক ফুলিয়ে চলতে চায়। এখন রাজনীতি ও
সমাজে সেই পরিবেশই বিরাজমান। এই অশুভ ব্যুহ ভাঙ্গা কঠিন; তবে অসম্ভব নয়। সেই লড়াইয়ে
জয়ী হতে হলে সব ধরনের নির্বাচন. কমিটি গঠনে সাচ্ছাদের মনোনীত করার বিকল্প নেই। শুদ্ধি
অভিযানের যে আহ্বান সেইটার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নেতা নির্বাচন করতে পারলেই কেবল
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘সবকিছু শুদ্ধ করার সংগ্রাম’ সফলতার মুখ দেখতে
পারে। ( লেখক: সিনিয়র সংবাদকর্মী ও কলামলেখক। সাবেক সভাপতি-ঈশ^রদী প্রেসক্লাব)।
২৫.৮.২০