প্রতি বছরই ঈদুল আযহার আগমণে সমগ্র পাড়া-মহল্লা তথা আমাদের বাড়িতে ঈদের আমেজ ছড়িয়ে পড়তো। গ্রামের লোকদের মাঝে কোরবানীর পশু কেনার ধুম পড়ে যেতো । আমাদের বড়িতে এব্যবস্থাটা প্রতি বছরই পাকা পোক্ত করা থাকতো। অর্থাৎ হালের বলদ ও দুধেল গাই পালনের পাশাপাশি ছাগল পালনেরও ব্যবস্থা ছিলো। জমি চাষের জন্য হাল বওয়া কামলাদের মাঠে ভাত নেওয়া এবং বাড়ির ফরমায়েজ খাটা যে ছেলেটি আপ খোরাকি(পেটভাতা) হিসাবে কিংবা অতি সল্প বেতনে কাজ করতো ছাগল দেখা শোনার দায়িত্ব বরাবর তার উপর ন্যস্ত থাকতো । আব্বা আম্মার ইচ্ছায় প্রায় প্রতিবছরই দুটি ছাগল পালন করা হতো । একটি কোরবানীর জন্য অপরটি বিক্রয়ের জন্য। বিক্রয়লব্ধ টাকা দিয়ে ঈদের কেনা কাটার বাড়তি সুবিধা হতো ।
পঞ্চাশের দশকের কথা। একবার আমাদের বাড়িতে সিদ্ধান্ত হলো এবার ঈদে একটি গরু কোরবানী করা হবে। আর গরু কিনতে গেলে যেতে হবে পাবনার মালিগাছা ইউনিয়নের বিশাল গরু হাট ‘টেবুনিয়ার হাটে।’ সপ্তাহের প্রতি বুধবারে সেখানে গরু-ছাগলের হাট বসে। ক্রেতা বিক্রেতাদের ভিড়ে ঈদের হাট হয় আরো জমজমাট। আব্বার সঙ্গে হাটে গেলে গুড়ের খোরমা, চুরমুর খাস্তা আর দেলখোশ খাওয়া যায়। সে লোভেই হোক আর কোরবানীর হাটের গরু কেনা-কাটা দেখার কারণেই হোক আমি হাটে যেতে চাইলে প্রথমেই কন্ঠ ভোটে তা নাকচ হয়ে যায়। বাড়ির সবাই বলে তুমি ছোট মানুষ ওই ভিড়ের মধ্যে তোমার হাটে যাবার দরকার নেই। প্রথমে মুখ গোমরা করে রইলাম। তাতে কাজ হলোনা। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিলাম, ব্যস তাতেই কাজ হলো। মা আমায় আদর করে খাওয়ালেন। সেই সাথে দাবিও মানা হলো। কারণ মা আমার ভালো করেই জানেন যে দাবি-দাওয়া না মানলে মাটির বদনা থেকে শুরু করে কাঁসার থালাবাটি-ঘটি সব ভাংচুর হবে। আর একবার ভাংচুর শুরু হলে কেউই তা রোধ করতে পারবেনা।
যাক, আব্বার সঙ্গে হাটে রওনা হবো। সঙ্গে গরু আনার জন্য বাড়ির দুজন কামলাকে নেওয়া হলো। তার সাথে গরু কেনার পর বেঁধে আনার জন্য পাটের মোটা দড়িও সঙ্গে নেওয়া হলো। গরু বিক্রেতা গরু বিক্রি করার পর দড়ি রেখে দেয়। এটাই রেওয়াজ। বৃষ্টি-বাদলের দিন বলে আব্বা বড়ো ছাতা এবং আমাকে একটি ছোট ছাতা দেওয়া হলো। আর কামলা দুজন মাথায় মাথাল এবং কাঁধে গামছা নিয়ে রওনা। বাড়ি থেকে বের হতেই রাস্তায় কাদা-পানি। প্রায় চার মাইল পথ কাদা-পানি মাড়িয়েই যাতায়াত করতে হবে। উঁচু কোন সড়কপথ নেই, সবই ডহর। সেই ডহর দিয়ে গরু-মহিষের গাড়ি চলাচল করায় ডহরকে বলা হতো গাড়ির নিরিখ। কোন সময় গাড়ির নিরিখ আবার কোন সময় জমির আইল বেয়ে, লোকজনের বাড়ির পাশের কোনা-কাঞ্চি পার হয়ে খালি পায়ে হেঁটে গরুর হাটে পৌঁছানো গেলো।
হাটে শুধু গরু আর গরু। কালো, ধলো, পাখরা রঙের বিভিন্ন সাইজের গরু। গরু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য গরু হাটে অসংখ্য দালাল। প্রত্যেক দালালের হাতে একটি করে ছোট আকারের লাঠি যাকে গ্রাম্য ভাষায় বলে ‘লড়ি’। সেই লড়ির মাথায় থাকে লোহার চিকন তীক্ষè ফলাকা। দালালেরা গরুর গায়ে আল ফুটিয়ে দিলে গরু লাফ-ঝাঁপ দেয়। এটাই নাকি ভালো জাতের গরু পরীক্ষার নিয়ম। এই আল ফোটানোতে আমার কচি মনে সেদিন দাগ কেটেছিলো। কষ্ট পেিেছলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম অবোলাকে এইভাবে শাস্তি না দিয়ে এর কি কোন বিকল্প পথ আবিষ্কার হবেনা কোন দিন?
দীর্ঘদিন পর হলেও আল্লাহ পাক সেই অবোলা গরুদের আলফোটানোর যন্ত্রণার কথা শুনেছেন। তাই এখন আর তাদেরকে কেউ আল ফুটাতে পারবেনা। বর্তমানে বৈশি^ক মহামারি করোনার কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটলেও গৃহপালিত পশু, গরু-ছাগল নিরাপদেই আছে। বিশেষ করে গুরুদের নিরাপত্তা বলয় এখন বেশ শক্তিশালী। কারণ তাদের গায়ে আর কেই আল মারতে পারছেনা। করোনা কালের জীবনধারায় এবারের কোরবানীর ঈদে যে পশু কোনা-বেচা হবে তার বেশিরভাগই হবে অনলাইনে।
তবে কোরবানীর গরু সরাসরি কেনা বা একসাথে হাটে যাওয়ার যে আনন্দ তা এখানে না পাওয়ার বেদনাও পোড়াচ্ছে কাউকে কাউকে। হাট থেকে গরু কিনে রাস্তা দিয়ে দড়ি ধরে বাড়ি ফেরার সময় দর-দাম জানতে চাওয়ার মজা থেকে এবার বঞ্চিত হতে হবে। করোনা সেই ব্যবস্থাই করে দিচ্ছে। এবারে গুরুর হাট বসানোকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অত্যাধিক বেশি বয়স্ক এবং কম বয়সিদের জন্য হাটে যাওয়া মানা। সীমিত আকারে গরুর হাট যেমন বসবে তেমনি ত্রেতা-বিক্রেতাদের দল বেধে হাটে না যেতে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছে। এক পথে গমণ অন্য পথে হাট থেকে বের হওয়া আরো কত কি আইন। অন্যস্থানে চলাফেরা করার সময় মাস্ক কানের লতির সঙ্গে, কিংবা থুতনির নিচে অথবা গলায় ঝুলিয়ে রাখলে কেই দেখভাল করেনা। কিন্তু হাটে গেলে অবশ্যই তা নিয়ম মাফিক মুখেই পরতে হবে। না হলে ভ্রাম্যমান আদালতে ধরা পড়ে জারমানা দিতে হবে। এতোসব নিয়ম কানুন মেনে চলা অনেকেরই অপছন্দ। তাই অনেকে এসব ফাই-ফরমায়েজের বাইরে অন লাইনে কোরবানীর পশু ক্রয়-বিক্রয়ে আগ্রহি হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদৌলতে এবং ডিজিটাল বিপ্লবের স্থপতি সজিব ওয়াজেদ জয়ের কল্যাণে বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হচ্ছে। করোনাকালে এই ডিজিটাল পদ্ধতি আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে বসেছে এবারের ঈদুল আজহার ঈদে কোরবানীর পশু কেনা-বেচায়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কমকে বলেন, করোনা মহামারি কালে সংক্রমণ প্রতিরোধে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে অন লাইনে পশু ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘অনলাইনে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে। দেশের ১১ হাজার ডিজিটাল সেন্টারের মাধমে পশু বিক্রেতারা বা খামারিদের অনলাইনে বিক্রিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী পলক বলেন, ‘‘ ফুড ফর নেশন’’ প্লাটফরমটি কোরাবানীর পশুর জন্য দেশের সব চেয়ে বড় ম্যাচ মেকিং ডিজিটাল হাট হতে যাচ্ছে।’’
বাংলাদেশ ডেইরিফার্ম এসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, গত বছর সারা দেশে ১ কোটি ৫ লাখ পশু কোরবানী হয়েছে। ঢাকা বিভাগে ২৫ লাখ এবং শুধু ঢাকা মহানগরীতে ১৮ লাখ পশু কোরবানী করা হয়েছে। সারা দেশে এসোসিয়েশনের ৮৪ হাজার সদস্য রয়েছেন, জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ জেলা বা উপজেলায় যারা সংগঠনের নেতা রয়েছেন তাদের বলা হয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে খামারি বা প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে যারা অনলাইনের মাধ্যমে গরু বিক্রি করতে চায় তাদের সাথে যোগাযোগ করে সাহায্য করতে। কারণ সবার স্মার্ট ফোন নেই। সদস্যরা ঢাকায় গরু নিয়ে আসতে চাইলেও তাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ ঢাকায় সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি। সাদেক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান বলেন, ‘‘ ইন্টারনেটে গরু কিনে কেউ যেন প্রতারিত না হয় এবং গরুর দালালদের হাতে না পড়ে এজন্য উপজেলা পর্যায়ে প্রাণি সম্পদ অফিস থেকে চাষিগণের সনদ সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। অনলাইনে বিক্রি করার সময় ক্রেতাকে সেই সনদ সরবরাহ করলে সে নিশ্চিত হবে। ’’ তিনি জানান, তার খামারে এবার দুই হাজার গরু প্রক্রিয়াজাত করে ক্রেতার বাসা পর্যন্ত পৌছে দিতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ৩৭৫ টাকা কেজি দরে (জীবন্ত গরুর ওজন) হিসাব করে বিক্রি করা হবে। ক্রেতা যদি প্রসেস করে নিতে চান তাহলে দামের ১২ শতাংশ সাভির্স চার্জ দিলে তা তার বাসা পর্যন্ত পৌছে দেওয়া হবে।
বৈশি^ক করোনাভাইরাস এবারে বাংলাদেশের মানুষদের ডিজিটাল কায়দায় কোরবানীর পশু ক্রয়-বিক্রয়ের প্রশিক্ষণ রপ্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অদুর ভবিষ্যতে সৌদি আরবে হজ করতে গিয়ে হাজী সাহেবগণ তাদের মুয়াল্লেম বা গ্রুপলিডারের মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে কোরবানীর পশু ক্রয় ও জবাইয়ের কাজ যেভাবে সম্পন্ন করে থাকেন করোনাকালের জীবনধারায় এদেশের মনুষদেরকেও তেমন করতে হবেনাতো? (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।