বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তরে ঘাসের চাদরে শুয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় অবগাহন করে যে মানুষগুলো মনের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা ধারণ করেছে। এদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও সাংবাদিকতার জগতে এক চির বিদ্রোহী নাম কামাল লোহানী।আজ শনিবার ২০ জুন ২০২০, ৬ অাষাঢ় ১৪২৭ সকাল ১০টার দিকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল রাজধানীর মহাখালীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন চির বিদ্রোহী এই মানুষটি। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যার পাশাপাশি ফুসফুস ও কিডনি জটিলতার পাশাপাশি হৃদরোগ ও ডায়াবেটিক সমস্যার পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যবরণ করেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল এবং সাংবাদিকতার জগতে, শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। চির বিদ্রোহের অধ্যায়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে সর্বক্ষেত্রে সর্বাগ্রে থাকা মানুষটির নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল এবং সাংবাদিকতার আকাশে একটি উজ্জল নক্ষত্রের নাম কামাল লোহানী। যে তারাটি আজ হারিয়ে গেছে আমাদের মাঝ থেকে। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার খানসনতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী ও রোকেয়া খান লোহানীর পুত্র কামাল লোহানী। যেই সবুজ প্রান্তর থেকে উঠে বাংলার মানুষের হৃদয় জয় করে আজ সেই খানসনতলা গ্রামেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন।৭ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের পর পাবনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে। পাবনা জেলা স্কুলে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে কামাল লোহানীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে প্রথম তাকে কারাগারে যেতে হয় মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে। মুক্ত জীবনে ফিরতে না ফিরতেই ১৯৫৪ সালে আবারও গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানী। দীক্ষিত হন কমিউনিস্ট মতাদর্শে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে পরের বছর আবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়ে একই কারাকক্ষে বন্দিজীবন কাটে।নৃত্যশিল্পের প্রতি আগ্রহ থেকে ১৯৫৮ সালে কামাল লোহানী যুক্ত হন নৃত্যশিল্পের সঙ্গে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিষেধাজ্ঞা জারি করলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সাহসী কর্মী প্রতিরোধ করেন। ১৯৬২ সালে কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন তার রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী একজন শিল্পী, একজন সাংবাদিক ও একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ বেতারের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ এর ১৫ অাগস্ট বঙ্গবন্ধু নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন কামাল লোহানী। ১৯৮১ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সু-সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।কামাল লোহানীর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয় দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায়। আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক প্রভাত, দৈনিক বার্তায়ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।সাংবাদিক ইউনিয়নে দুই দফা যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংবাদিকতার জন্য ২০১৫ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দুই বার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন কামাল লোহানী। ছায়ানটের সম্পাদক ছিলেন পাঁচ বছর, ছিলেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতিও। বর্তমানে ছিলেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা ।বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার আকাশ থেকে হারিয়ে গেল একটি ধ্রুবতারা। আমরা কামাল লোহানীর জীবনাবসানে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে শূন্যতা তৈরী হলো তা পূরণ হওয়ার নয়। আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
#মোহাম্মদ কানিছুর রহমানউপ-রেজিস্ট্রারমাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইলওসম্পাদক মণ্ডলীর সদস্যবঙ্গবন্ধু-বীক্ষণ