নবী করিম (সা.) এর সাহাবীহজরত রতন ইবনে নাসর হিন্দি (রা.)

// এবাদত আলী
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রিয় হাবিব হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর অগণিত সাহাবা আজমাইনদের মধ্যে সব চেয়ে বয়স্ক সাহাবী ছিলেন ভারত বর্ষীয় সাহাবী হজরত বাবা রতন ইবনে নাসর হিন্দি (রা.)। অনেকে রতন হিন্দি (রা.) কে হিন্দ থেকে প্রথম মুসলমান সাহাবী বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন। তিনি দীর্ঘ ৭০০ সাত শ’ বছর জীবিত ছিলেন।
হজরত রতন আল হিন্দি (রা.) ছিলেন ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের ভাতিন্দা গ্রামের অধিবাসী। পেশায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি হিন্দ (তৎকালিন ভারতবর্ষ) থেকে আরব দেশ হয়ে দামেস্কে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। লেখক মুহাম্মাদ জাহিদ হাসান আল-মাতুরিদীর বর্ণনা হতে জানা যায় তাঁর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী অত্যন্ত চমকপ্রদ।
তিনি নিজেই এর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,‘‘ যখন আমি ছোট ছিলাম তখন আমরা মক্কার মধ্য দিয়ে হিন্দ এবং দামেষ্কে বাণিজ্য করতে যেতাম। মক্কার একটি উপত্যকা ছিলো যেখানে কুরাইশ এবং আরবের অন্য লোকেরা তাদের পশুপালনের জন্য নিয়ে যেতো আর যেহেতু ওখানে ভুমি ছিলো সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। পর্বতগুলোতে ছিলো ছোট ছোট স্বোতস্বিনী নদী যা দিয়ে পানির উঞ্চ প্র¯্রবণ বয়ে যেতো।
একবার ঐ অঞ্চল দিয়ে যাবার সময় ঝড়ো-বুষ্টির কবলে পড়লাম। সেখানে আমাদের কাফেলাকে কিছু সময়ের জন্য থামতে হয়। আমরা সেখানে একটি ছোট সুন্দর বালকের দেখা পেলাম যে মেষ চরাচ্ছিলো এবং একটি ¯্রােতস্বিনী ছোট্ট নদী পার হতে উদ্যত ছিলো। মেষগুলো লাফ দিয়ে ছোট্ট নদী পার হয়ে গেলেও বালকটি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো এই আশায় যে কেই আসবে এবং তাকে নদীটি পার করে দিবে।
কিন্তু আশে পাশে বড় কাউকে পাওয়া গেলনা যে তাকে কোলে তুলে নদীটি পার করে দিবে। অতঃপর বাবা রতন হিন্দি শিশুটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে সেই ছোট্ট নদী পার করে দিলেন। পার করে দিবার পর শিশুটি বাবা রতন হিন্দির জন্য প্রাণ খুলে হায়াত বৃদ্ধির জন্য দোয়া করলেন। তিনি বল্লেন, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘ জীবন দান করুন এবং সে তা ( একই বাক্য ৭ বার বল্লেন)। বাবা রতন হিন্দি খুব অবাক হলেন ছোট্ট শিশুটির এমন আবেক ভরা দোয়া দেখে। তিনি বলেন, এপর আমি আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু ছোট্ট বালকটির কথা আমার বারবার মনে পড়তে লাগলো কেননা এত কম বয়সি এমন সুন্দর আর মার্জিত ব্যবহারের ছেলে আমি কখনো দেখিনি।’’
দিন যায়, মাস যায়, পঞ্চাশ বছরকাল পরের কথা। রতন হিন্দি বলেন আমরা এক রাতে ভাতিন্দার (হিন্দ) একটি জঙ্গলে পর্বতের উপর বসেছিলাম। পুর্ণিমার চাঁদ তার দীপ্তি ছড়াচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ আমরা দেখলাম চাঁদটি দু টুকরো হয়ে আবার আগের মতই জোড়া লেগে গেলো। । আমরা কি ঘটছে তা দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
এই আশ্চর্য ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর একদল আরব বণিক এলো হিন্দে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করলাম এ জাতীয় কিছু ঘটেছে কিনা। সুতরাং আরব বণিকেরা বল্লো যে এটা ঠিক। মক্কায় এক যুবক আছে যার নাম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম। তিনি বলেছেন যে ‘‘ আমি আল্লাহর নবী।’’
রতন হিন্দি বলেন যে আমরা চিন্তা করলাম এই যুবকটিকে দেখবো। আমরা মক্কায় গিয়েছিলাম, তখন বলা হয়েছিলো যে তিনি মদীনায় গেছেন। আমরা মদীনায় পৌঁছে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে দেখলাম একজন সুন্দর ব্যক্তি তাঁর সাহাবীগণ দ্বারা বেষ্টিত হয়ে বসে আছেন। যিনি ছিলেন মহা নবী (সা.)। আর আমি যেন পুর্ণিমার চাঁদকেই আবার দেখলাম। ’’
আমি তাঁকে বল্লাম আমরা কিছু মোজেজা দেখেছি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) জবাব দিলেন, হে রতন হিন্দি এই মোজেজাকি যথেষ্ট ছিলোনা যখন আপনি আমাকে আপনার কাঁধে নিয়ে নদী পার করেছিলেন আর আমি আপনার দীর্ঘ জীবনের জন্য দোয়া করেছিলাম। এটি শুনে রতন হিন্দি হুজুর (সা.) এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করলেন।
রতন হিন্দি বলেন আমি কিছুদিন সেখানে ছিলাম এবং কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর যখন ফিরে এলাম আমাদের আর তাঁর সন্নিধ্যে যাবার সুযোগ হয়নি। (সুত্র ঃ হজরত ইবনে হাজর আসকালানী (র.) কর্তৃক লিখিত গ্রন্থ ‘‘ আস সাহাবাহ ফি তামিজী সাহাবাহ’’ খন্ড ২ পৃষ্ঠা ৫৩০-৫৩১)।
মুসলিম ইতিহাসবিদদের মতে হজরত বাবা রতন ইবনে নাসর হিন্দি (রা.) ই সবচেয়ে দীর্ঘজীবি সাহাবী। তিনি ছিলেন ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। যখনি কেউ তার দরবারে তাকে দেখার জন্য যেতেন তিনি হাদীস এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বর্ণনা করতেন। আন্দালুসিয়া (তৎকালিন স্পেন ) এবং মধ্য এশিয়া (বর্তমান উজবেকিস্তান, আশে পাশের দেশ এবং তুরষ্ক অঞ্চল) থেকে অনেক হাদীস সংকলক তাঁর কাছে আসতেন হাদীস শুনে সংকলনের জন্য। স্পেনীয় ইতিহাসবিদ আবু মারোয়ান আন্দালুসি একবার বাবা হাজি রতন (রা.) কে দেখতে আসেন এবং তাঁর একটি আকর্ষনীয় চিত্র অংকন করেন। তিনি যখন বাবা রতন (রা.) এর দরবারে পৌঁছালেন সেখানে অতিকায় জরজীর্ণ একজন বৃদ্ধকে দেখে তিনি বিস্ময়াভিভুত হয়ে গেলেন যার গাল ছিলো তুলার মত সাদা সাদা দাড়িতে আবৃত।
সেই বৃদ্ধ (হজরত রতন হিন্দি রা.) মারোয়ান আন্দালুসিকে প্রাচীন একটি ভাষায় সম্বোধন করলেন যার অর্থ তিনি বুঝতে পারলেন না। তবে পরে এর অনুবাদ করে বলে দেওয়া হলো। যার মানে হলো তিনি খন্দকের যুদ্ধের প্রাক্কালে পবিত্র মদীনায় ছিলেন।
হজরত বাবা রতন হিন্দি (রা.) এর বর্ণনা আরো কয়েকটি মধ্য যুগীয় গ্রন্থে পাওয়া যায় যেমন, মোঘল সুলতান জাহাঙ্গীরের আমলে লিখিত গ্রন্থ ‘‘ গুলজারই আবরার’’ এ বর্ণিত আছে , হজরত রাজি আল দীন, আলী ইবনে সাঈদ লালা ইবনে আব্দুল জালীন গজনবী (র.) বলেন, ‘‘ যখন আমি ৬২৪ হিজরিতে হিন্দে ভ্রমণ করি আমি বাবা রতন হিন্দি (রা.) এর সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে রাসুল (সা.) এর বরকতপূর্ণ দরবার সম্পর্কিত কিছু হাদীস বর্ণনা করে শোনান।’’
এছাড়াও শায়খ আলাউ আল দীনাসনানী (র.) তাঁর ‘‘ ফাসল আল খিতাব’’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজর আসকালানী (র.) তাঁর ‘‘আল আসাবাহ ফী তারিফ আল সাহাবাহ’’ গ্রন্থে হজরত রতন হিন্দি (রা.) থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। আরো বর্ণিত আছে যে, সুলতান মাহমুদ গজনবী একবার এমন কারো কাছ থেকে হাদীস শুনতে চাইলেন যিনি কোন মাধ্যম ছাড়াই হুজুর পাক (সা.) থেকে সরাসরি হাদীস শুনেছেন। ইতোমধ্যে তিনি বাবা রতন হিন্দি(রা.) এর কথা জানতে পারলেন যিনি নিজেকে সাহাবী বলেন। অনেক চেষ্টার পর যখন বাবা রতন হিন্দি (রা.) কে সুলতান মাহমুদের দরবারে আনা হলো, তিনি সুলতানকে দুটি হাদীস বর্ণনা করে শুনালেন।
কিছু বর্ণনা অনুসারে হজরত রতন আল হিন্দি (রা.) ১২৩৩ বা ১২৪৩ খিষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মাজার শরীফ পাঞ্জাবের ভাতিন্দা মহল্লার হাজি রতন নগরে অবস্থিত। মাজার শরীফটি ভারতের পাঞ্জাব ওয়াক্ফ বোর্ড পরিচালনা করেন। ( সংগৃহিত)।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, তারিখ: ৩১/০৮/২০২৩.