ফেলে আসা দিন গুলো-২৯

এবাদত আলী
১৯৭১ সালের শুরুতেই সমগ্র পুর্ব-পাকিস্তানের আপামর জনগণ বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সকলেই এক কাতারে শামিল হয়। দেখতে দেখতে ১লা মার্চ এসে গেল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ আহুত জাতীয় পরিষদের বৈঠক বানচাল বলে রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা করার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পুবর্-পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। আর এই অসহযোগ আন্দোলনের জন্য গোটা বাংলার মানুষ তখন প্রস্তুত। মার্চ মাসের ৩ তারিখ হতে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।। তখন পাবনা জেলা ছাত্র লীগের সভাপতি ও জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসাবে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার) ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’কে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন । তার নেতৃত্বে রফিকুল ইসলাম বকুলসহ পাবনা জেলার ছাত্র-জনতা এক কাতারে শামিল হয় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং পাবনার বিক্ষুব্ধ জনতা এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাবনা শহরে মিছিল বের করে এবং ৩ মার্চ থেকে পাবনাতে একটানা চারদিন হরতাল পালিত হয়।
ঠিক এই সময় পাবনা জেলার বিশাল অঞ্চল বিশেষ করে পাবনার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মালিগাছা মালঞ্চি, হিমায়েতপুর ও দাপুনিয়া ইউনিয়নে সব চেয়ে বড় সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর তা হলো এই এলাকাটি নকশালেরা তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে।
ষাটের দশকের শেষ দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি নামাক স্থানে এক উগ্রপন্থি নেতা চারু মজুমদার যিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। সেই চারু মজুমদার নকশাল বাড়িতে বিস্ফোরন ঘটায় এবং তখন তিনি সকলের নিকট নকশাল নেতা হিসাবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভাসানী ন্যাপেরে কিছু নেতা-কর্মি এই নকশালী তৎপরতায় যোগ দেয় এবং নিরীহ মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে থাকে।
পাবনার আমিনুল হক টিপু বিশ্বাস,বারি সরদার, আখতারুজ্জামান আখতার, রাধানগরের নুরু খন্দকারের ছেলে মাসুদ, নুরপুরের শহিদ (স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিহত), পৈলানপুরের খোকন, কাশেম বিশ্বাস, (মৃত), পাবনা শহরের হামিদ, দাপুনিয়া ইউনিয়নের টিকরি গ্রামের রজিবুল্লা বিশ্বাস ওরফে রতন বিশ্বাস (নিহত) , তার বড় ছেলে জমশেদ (নিহত), কাসেম, মান্নান, ছলেমান, ভজলু, জোতআদম গ্রামের দেলোয়ার হোসেন (নিহত), বাদলপাড়ার লালচাঁদ (নিহত), মকবুল (নিহত), হায়াত আলী, আলেপ (নিহত), শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামের এস্কেন্দার (নিহত), গাফ্ফার (নিহত), জলিল (নিহত), শহিদ (নিহত), হামিদ ওরফে হক্কেল, মহব্বত খোনকার (নিহত), মোসলেম (নিহত), হারুন (নিহত), মতি (নিহত), হাকিমদ্দিন মোল্লা (নিহত), মজনু (নিহত), ভাঁজপাড়া গ্রামের মুঞ্জিল (স্বাধীনতার পরে নিহত), চাঁদপুর গ্রামের আলীউজ্জামান, মালিগাছা ইউনিয়নের মালিগাছা গ্রামের ফরিদ (নিহত), নবাব আলী, মজিবর, মান্নান, হান্নানসহ শতাধিক ব্যক্তি নকশালী তৎপরতা শুরু করে। এসময় ইসলামী ছাত্র সংঘ নামে (পরে ছাত্র শিবির) একটি সংগঠন ছিলো যারা জামাতে ইসলামীর লেজুড়বৃত্তি করতো। ছাত্রদের আরেকটি সংগঠন ছিল য়ার নাম ছিল এন এস এফ । এই এন এস এফ এর সক্রিয় নেতা ছিলেন রাধানগর মজুমদার পাড়ার আব্দুল বাতেন, পাবনা শহরের রিদ্দিক (পরে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে শহীদ), আটঘরিয়ার শাহজাহান আলী, (বর্তমানে এ্যাডভোকেট ও অধ্যক্ষ), আব্দুস সাত্তার মোল্লা (সাবেক চেয়ারম্যান দেবোত্তর ইউনিয়ন পরিষদ, আটঘরিয়া, পাবনা,( মৃত),
আমরা যারা পুর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের সদস্য এবং অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম নকশালরা তাদেরকে তাদের দলে ভিঁড়াবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করতো। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বিধায় আমরা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হইনি। নকশালদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আমাদের জীবনের উপর হুমকি ছিল যথেষ্ট। কারণ তাদের কাছে তখন অস্ত্র ছিল প্রচুর। হিমায়েতপুরের পশ্চিমে দিয়াড়বোয়ালিয়াতে তাদের একটি অস্ত্র ভান্ডার ছিল। সেই অস্ত্র ওরা এই সকল এলাকার অশিক্ষিত যুবক ও শিক্ষিত বেকার যুবকদের মাঝে বিতরণ করে দেয়। ফলে আমাদের জন্য তখন এলাকায় অবস্থান করাটাই ঝুঁকিপুর্ন হয়ে ওঠে।
তার পরও আমারা সাহস হারাইনি। আমাদের এলাকার শতাধিক যুবক ও ছাত্রকে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসাবে একত্রিত করে এক কাতারে ধরে রেখেছিলাম। আমাদের গ্রামের পাশে বাঙ্গাবাড়িয়া দাখিল মাদ্রাসা। এই মাদ্রসার নিকটে একটি প্রকান্ড বট গাছ ছিল আমাদের ঠিকানা। পদ্মার শাখা বাঙ্গর নদীর উত্তর তীর ঘেঁষে এই বটগাছের নিচেই প্রতি দিন বিকালে একই সময়ে আমরা হাজির হতাম। আলোচনা হতো দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। চলতো শলাপরামর্শ ।
১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা সেই উত্তাল মার্চে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সমগ্র পুর্ব-পাকিস্তানের কৃষক শ্রমিক, ছাত্র জনতা এক কাতারে শামিল হলে সারা দেশের ন্যায় পাবনার প্রশাসনও অচল হয়ে পড়ে।
গোটা প্রশাসনের চালক তখন আওয়ামী লীগ নেতা ও পাবনা ৫ আসনের এমএনএ আমজাদ হোসেন (মৃত ৬ এপ্রিল, পাবনা সদর হাসপাতালে, ১৯৭১), এ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন (স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ), ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী (১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেল খানায় বন্দী অবস্থায় শহীদ), এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন ও অ্যাডভোকেট গোলাম হাসনায়েন (মৃত), আব্দুর রব বগা মিয়া (স্বাধীনতার পরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ), ওয়াজি উদ্দিন খান (উদ্দিন ভাই (সাবেক এমপি, প্রখ্যাত মোটর শ্রমিক নেতা, মৃত)), আব্দুল গণি (মৃত), প্রমুখদের হাতে।
পাবনার ডিসি নুরুল কাদের খান, এবং পাবনার পুলিশ সুপার এই দুজনে তখন আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায় তাঁরা প্রশাসন চালাতেন। সারা দেশের ছাত্র-জনতার কন্ঠে তখন একই ধ্বনী ‘ বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। বাঁশের লাঠি তৈরি করো পুর্ববাংলা স্বাধীন করো। পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। জয় বাংলা, জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। জয় বঙ্গবন্ধু। ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঢাকা থেকে খবর আসে যে, বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চে রমনা রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিয়ে পরবর্তী কর্মসুচি ঘোষণা করবেন। আকাশবাণী বেতার থেকে এই ভাষণের কথা বার বার প্রচার করা হলো।
সেই সাথে আমাদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ট্রেনিং ও জোরদার করা হলো। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।