বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনঃ একটি ঐতিহাসিক দিন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহবানে সমগ্র বাঙালি জাতি  সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলো। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিলো আমাদের স্বাধীনতা। ২৫ মার্চের মধ্য রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর আহবানকে মাথায় রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্থানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। অগনিত জনতা তাকে স্বাগত জানায় জয় বাংলা স্লোগানে। তিনি দেশের মাটিতে পা রেখেই দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।  শোষণ নিপীড়নের সীমা যখন ছাড়িয়ে যায় তখনই মুক্তি দূত হিসাবে আর্বিভূত হোন এমন কোন মহানায়ক যিনি দাসত্বের শৃংঙ্খল ভেঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা। বিশ্ব ইতিহাসের তেমনি একজন মহানায়ক হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান যিনি নিপীড়নের দুর্ভ্যেদ্য দেয়াল ভেদ করে বাঙালিদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন মুক্তির বারতা এবং স্বৈরাচারের নাগপাশ থেকে দেণকে মুক্ত করে বাঙালিদের উপহার দিয়েছিলে বহু বছরের কাঙ্খিত গণতন্ত্র। তিনি ছিলেন এমনই একজন নেতা যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের স্ফুলিংগে তিমিরাচ্ছন্ন গগণে উদিত হয়েছিলো স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য এবং যার একটি ভাষণই ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এক মহা প্রলয় সৃষ্টি করেছিল যা এখন রীতিমত বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য দলিল।  একটি বদ্ধ প্রকষ্ঠে আটকে পড়া জাতিকে উদ্ধার করার জন্য এমন ভাষণ বিশ্বে বিরল। কৃমি কীটে খাওয়া দগ্ধ শাসন ব্যবস্থার বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছিল বাঙালি জাতি, আর এমনই এক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে আলোর স্ফূরন ছড়িয়ে ছিল এবং বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে ঝংকার তুলেছিলো। অর্ধশত বছর আগে দেয়া সেই কালজয়ী ভাষণেই মুক্তির  আস্বাদন পেয়েছিল বাঙালি জাতি। ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো এবং এমনই অনুপ্ররণামূলক ভাষণ ছিল সেটি যা মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল এবং বুকের তাজা রক্ত দিতে বাঙালি নূন্যতম কুণ্ঠাবোধ করেনি। বাংলাদেশ আজ

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে গর্বের সাথে। ৫০ বছর আগে সেই ভাষণটি না দিলে আমরা আজ সুবর্ণ জয়ন্তী করতে পারতাম না। মুজিব শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এমন একজন মানুষকে নিয়ে দু কলম লেখার সাহস করছি যাকে হিমালয়ের সাথে তুলোনা করা হয়েছে। আর এই তুলোনাটি কোন সাধারন লোকে করেননি। এই তুলোনাটি করেছিলেন কিউবা নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। হিমালয় তুল্য এই মানুষটি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি শুধু একজন মহানায়কই নন, তিনি নিজে একটি  প্রতিষ্ঠান এবং একটি ইতিহাস।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া ছোট খোকা ধীরে ধীরে কালের আবর্তে ইতিহাসের মহানায়কে পরিনত হলেন যেটা মোটেও সহজ ছিল না। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে তাকে মোকাবেলা করতে হয় অত্যাচার, নির্যাতন আর ষড়যন্ত্রের বিষাক্ত ছোবল। প্রকাণ্ড ঝড়ের মাঝে উত্তাল সাগরে টিকে থাকা তরীর মত তার জীবন। পাহাড় সম ঢেউ এসেও তার ইচ্ছা তরীকে ডুবাতে পারেনি। এমনটি শুধু কোন মহাবীরের পক্ষেই সম্ভব। সীমাহীন সাহস, অসীম আত্মবিশ্বাস, উপস্থিত বুদ্ধি, প্রজ্ঞা এবং মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা তাকে নক্ষত্রে পরিনত করেছে।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার জন্ম। স্কুল থেকেই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে অসীম সাহসিকতার জন্য শেরে বাংলা তাকে বুকে টেনে নেন। ১৯৪০ সালে তিনি মেট্রিক পাশ করেন এবং কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ইসলামিয়া কলেজে পড়া অবস্থায় তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন ১৯৬৬ সালে তিনি ৬ দফা পেশ করেন। এর প্রথম দফাটি ছিল স্বায়ত্বশাসন। এটি ছিল মুক্তির সনদ। এসময় তিনি একাধিকবার গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয় এবং গ্রেফতার হন। ১৯৬৯ সালে তিনি গনঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কারামুক্ত হন। এ বছর তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরষ্কুশ জয় লাভ করে।  ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা শুরু হলে তিনি আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে তিনি বাংলার মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে কালজয়ী ভাষণ দেন। ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার দল।  এই রাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর পর তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সরকার প্রধান হন। ১৯৭২ সালে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সংবিধান কার্যকর হয়।  তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যার কাছে নিজের সুখ ছিল খুব তুচ্ছ। তার মত দূরদর্শী নেতা বিশ্বে বিরল। তিনি ছিলেন গণতন্তের পুজারী এক নির্ভীক দুর্জয় সাহসী জাতীযতাবাদী নেতা। অমানিশার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত দাসত্বের করাল গ্রাসে নিপতিত একটি জাতির জন্য তিনি এলেন আলোর দিশারী হয়ে। তিনি ছিলেন  বিশ্ব আইকন, নেতৃত্বের জাদুকর, ইতিহাসের এক বিরাট মহীরুহ। তিনি ছিলেন সৎ, বলিষ্ঠ, অদম্য, দুর্বার ও বিদ্রোহের অগ্নিশিখা। কিংবদন্তি কালজয়ী এই নেতার কণ্ঠে ছিল ইন্দ্রজাল। যার বজ্রকণ্ঠের ভাষণ ইতিহাসের বড় দলিল হয়ে গেছে। ক্ষণজন্মা এই পুরুষ ছিলেন মুক্তির দিকপাল, এক মহা কান্ডারি এবং মানবতাবাদের ক্যানভাসে গণতন্ত্রের দিশারী।

তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, এক বিরাট বটবৃক্ষ এবং বাতিঘর, যিনি ছিলেন স্বৈরাচার শাসনের বিরুদ্ধে এক প্রবল ঝড়।  সাত কোটি বাঙালির প্রাণের প্রদীপ বিশ্ববরেণ্য এই নেতা ছিলেন দেশ প্রেমের এক মূর্ত প্রতীক।  রাজনীতির এই মহাকবি ছিলেন তিমিরাচ্ছন্ন গগনের এক দীপ্ত রবি। শোষণের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক মহা স্ফুলিঙ্গ যিনি মহাপ্রাচীর ভেঙ্গে ছিনিয়ে এনেছেন পতাকা এবং একটি মানচিত্র। বাংলার নৃপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুণ্ঠ, সদাশয় ও দূরদর্শী। জননন্দিত, অবিসংবাদিত, অস্প্রদায়িক, সেক্যুলার,  আপোষহীন এই বিশ্বনেতার চলার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না।

তার স্বর্নালী দিনগুলি কেটে গেছে রাজপথ,আন্দোলন-সংগ্রাম আর কারাগারের অন্ধ কুঠিরে। স্বপ্নের কারিগর, অনলবর্ষী এই বক্তা তার সহজাত গুণের কারণে ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। বিশ্বের বহু নেতা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন এমন নজির খুব কম। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন এক ব্যক্তি তিনি যা ভেবেছেন তা শুরু করেছেন, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং সেটার ফসল ঘরে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। আর তার শ্রেষ্ঠত্ব ঠিক এখানেই। ধারাবাহিক সংগ্রামের বলিষ্ঠ এই বীর হিমালয়ের মত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন যা ভেদ করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। যার মহান নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসে পরাক্রম একটি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাঙালিরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল।

তিনি এমন এক ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যার কথায় ও ভালোবাসার টানে বাঙালিরা জীবন দিতে রাজি ছিল। বাঙালি জাতির মুক্তির দূত, নীতিতে অবিচল, উজ্জীবনী শক্তির ধারক আপন শক্তি বলে প্রকাণ্ড প্রতিবন্ধককে দুমড়ে মুচড়ে ফেলেছিলেন।  টর্ণেডোর মত ক্ষিপ্রগতিতে তিনি হাজার বছরের বদ্ধ খাঁচার দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন।  পরাধীনতার লৌহ শিকলে আটকে থাকা একটি জাতিকে তিনি মুক্ত করেছিলেন। কোন ভয়,  কোন ষড়যন্ত্র, কোন ফাঁদ,  কোন হুমকি তার এগিয়ে যাওয়ার পথকে প্রতিহত করতে পারেনি।  তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ঘটেছিলো মুক্তির সমর। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের যে নেতৃত্ব তিনি দিয়েছিলেন তা বিশ্বে বিরল। ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলো দেশকে ভালোবেসে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মুক্তিযুদ্ধে। আজ আমাদের স্বাধীনতা ৫০ পেরিয়ে ৫১ এ পদার্পন করলো। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আজও আমরা পরাধীন থাকতাম। স্বাধীন দেশে বাস করে মুক্ত বায়ুতে শ্বাস নিতে পারছি এই মহান মানুষটির জন্য।  স্বাধীনতার স্বাদ যে জাতি এখনো পাইনি তারা বোঝে স্বাধীনতার মূল্য কত।

তিনি তার ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া নিয়ে কোন স্বপ্ন দেখতেন না। তার গগনচুম্বী  স্বপ্ন ছিল বদ্ধ প্রকষ্ঠে আটকে থাকা অসহায় মানুষগুলিকে মুক্ত করে স্বাধীনতার স্বাদ দেয়া। বাঙালি জাতি যে শিকলে বাঁধা পড়েছিল সেটা ভেঙ্গে দেয়াই ছিল তার মহা ব্রত।
তিনি তার মূল স্বপ্নটি পূরুণ করতে পেরেছিলেন। মুক্তির পরম স্বাদ তিনি বাঙালিদের দিয়েছিলেন। বিশ্বের একজন ত্যাগী সংগ্রামী নেতা হিসাবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। অসীম সাহসিকতার জন্য ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজ বঙ্গবন্ধুকে ” টাইগার অব বেঙ্গল” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। বাঙালিয়ানার প্রবাদ পুরুষ এই মানুষটির বাঙালির প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। যুদ্ধ বিধস্ত দেশটিকে তিনি যখন নতুনভাবে সাজানো শুরু করলেন ঠিক তখনই কতিপয় জঘণ্য কুচক্রী কিছু অমানুষ তার বুকে গুলি চালালো নির্মমভাবে। বিশ্বাসঘাতকদের হাতে প্রাণ হারালেন তিনি ও  তার পরিবার। সৃষ্টি হলো ইতিহাসের সবচেয়ে জঘণ্য কলঙ্কিত অধ্যায়।