এবাদত আলী
আমাদের সহপাঠি ও বন্ধু ফরজ আলীর বাড়ি থেকে তার ছোট ভাইয়ের বিয়েতে বরযাত্রি হিসেবে আমরা মহিষের গাড়ি বহর নিয়ে আত্মীয়-কুটুম ও পাড়া প্রতিবেশিসহ রওনা হলাম। সারা পথ নারায়ে তকবির- আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিতে দিতে একসময় বিয়ে বাড়িতে পৌঁছানো হলো।
বিয়ে বাড়িতে পৌঁছা মাত্র বরের গাড়ির নিকটে বেশ কয়েকজন মুরুব্বি এলেন। তারা বরের হাতে সোনার আংটি পরিয়ে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে হাতের আঙ্গুল ধরে গেট পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। কিন্তু বর এবং বরযাত্রিরা সেই গেটে বাধাপ্রাপ্ত। গোটা চারেক কলা গাছ পুঁতে বাঁশের বাখারি দিয়ে ঘেরা হয়েছে গেটটি। কয়েকটি শাড়ি কাপড় দিয়ে কলাগাছ কিছু রঙিন কাগজ দিয়ে মোড়ানো হয়েছে বাখারি গুলো। গেটে টাকা দিতে হবে। বরের ভগ্নিপতি হলেন বরের কোলদারি। বরের যাবতীয় দায় দায়িত্ব তার কাঁধে। কোলদারি কর্তৃক চাহিদা মত টাকা না দিলে বরের জন্য বিয়ের আসরে প্রবেশাধিকার নেই। এই গেটের মালিক বরের শ্যালক-শ্যালিকারা। গেটের মাঝখানে একটি কাঠের পুরোনো টেবিল। টেবিলের ওপর একি বগি থালায় করে গ্লাসে পানি, আখের গুড়ের সরবত চিনির সরবত এবং শুকনা মরিচ গুলানো সরবত। বরকে ঠকানোর জন্য এ ব্যবস্থা। পেটের মালিকেরা অনুমতি না দিলে টেবিল না সরালে কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেনা। গেটের বাইরে তাই আমরা াপেক্ষা করতে লাগলাম। গেটের মালিকদের উপরে কেউ কোন খবরদারি করেনা। পরিস্থিতি যদি কোন কারণে নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে থাকে তখনই কেবল মুরুব্বিরা হস্তক্ষেপ করেন। গেট তৈরি ও নিয়ন্ত্রণকারিদের দাবি ১শ টাকা। বরের কোলদারি প্রথমে ১০ টাকা বলায় গেটের মালিকেরা বিরক্ত বোধ করে। কেউ কেউ বলে এমন ছোট লোক কোলদারি তো কোনদিন দেখিনি। আরেকজন বলে দরদাম করেন একি মাছের বাজার। কোলদারি বলেন ২৫ টাকা। তাতেও না। ৫০ টাকা এরপর ৭৫ টাকা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা। ১শ টাকাই দিতে হলো। টাকা পাবার পর বর এবং কোলদারিকে সরবত দেওয়া হলো। বরের কোলদারি আগে গ্লাসের মধ্যে আঙ্গুল চুবিয়ে স¦াদ গ্রহণ করে। তারপর বরকে দেয় এবং নিজে খায়। অতঃপর টেবিল সরিয়ে বর এবং বরযাত্রিকে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলো।
আমরা ভিতরে গিয়ে বর এবং বরযাত্রিদের জন্য নির্ধারিত ঘরে গিয়ে বসলাম। আমাদের জন্য ঘরের কাঁচা মেঝেতে গরুর গোবর দিয়ে লেপা-পোছা করা হয়েছে। তারউপর বিছানো হয়েছে খেজুরের পাতার তৈরি সপ বা মাদুর, তার উপরে কাঁথা। বসতেই গোবরের মৃদু গন্ধ নাগে লাগে। কিন্তু কেউ কোন মন্তব্য করেনা। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে নাকি কোন খুত ধরতে নেই।
যাক আমরা বসতেই সকলকে সরবত খেতে দেয়া হলো। আখের গুড়ের সরবতের সঙ্গে লেবুর পাতার রস দিয়ে সুস্বাদু করা হয়েছে। বিয়ে বাড়িতে অবিরত মাইকে কলের গান বেজে চলেছে। গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গান ‘ ও পরানের হুক্কারে তোর নাম কে রাখিলো ডাব্বা।’ ও ওকি গাড়োয়ান ভাই হাঁকাও গাড়ি চিলমারির বন্দরে।’ কন্ঠ শিল্পী আব্দুল আলিমের গানই বেশি যেমন ‘বহু দিনের পিরিতি বন্ধু……,এই যে দুনিয়া কিসের ও লাগিয়া…..হলুদিয়া পাখি সোনার বরণ………, সর্বনাশা পদ্মা নদীরে…….., কেহ করে বেচা-কেনা…….,আমারে সাজাইয়া দিও নওশার ও সাজন…….., পরের যায়গা পরের জমি ঘর বানাইয় আমি রই…….., সেপারে তোর বসত বাড়িরে………, ইসলামি গজল নবী মোর পরশ মনি নবী মোর সোনার খনি……….এবং মনে বড়ো আশা ছিলো যাবো মদীনায় ইত্যাদি ইত্যাদি। মাইকের শব্দে কান ঝালাপালা। কিন্তু উপায় কি অনুষ্ঠান শুরুর আগে পিছে কয়েকদিন ধরে যে বাড়িতে কলের গানের মাইক বাজবে তারা এলাকার মধ্যে ততই বনেদি।
এবার বিয়ে পড়ানোর পালা। বিয়েতে কন্যাকে সাজগোজ করানোর জন্য এবং সমাজের জন্য আয়-দায় বুঝে দেওয়া। যাকে বলে আড়ির সদায়। একটি বড়সড় টিনের বাক্সে ভরা কন্যার গায়ের গহনা। এখন যেমন স্বর্ণের ভরি ৮৭ হাজার ২শ ৪৭ টাকা তখন ১ ভরি সোনার মুল্য ছিলো মাত্র ১শ ২০ টাকা থেকে ১শ ২৫ টাকা। তাই কন্যার গলায় সোনার বাজু হার, কানে ঝুমকো লতা দুল, হাতে রুলিবালা, নাকে নাকফুল ও বেশর, সিঁথায় টিকলি, পায়ে খাড়–য়া, হাতের আঙ্গুলে আংটি ইত্যাদি গহনা, বিয়ের বেনারশি শাড়ি, রøাউজ, ছায়া, গামছা, আটপৌরে শাড়ি, পায়ের ১ জোড়া চটি বা চপ্পল, প্রসাধনির মধ্যে পায়ের আলতা, হাতের আঙ্গুলের জন্য কুমকুম, মুখের জন্য হিমানি-পাউডার,আয়না, কাঁকই, রুমাল, গায়ে মাখা সাবান ইত্যাদিতে ঠাসা। অপর একটি টিনের বাক্সে শিংরানোর জন্য অর্থাৎ বিয়ের কন্যাকে যারা সাজগোজ করাবে তাদের জন্য একটি ননদটেপারিতে ভরা সদায় যেমন ছোট ছোট কয়েক খানা গোল আয়না, কাঁকই, হিমানি- পাউডার, আলতা, কুমকুম, সাবান, রুমাল ইত্যাদি। তার সঙ্গে কয়েক বেড়ি পান এবং বেশ কিছু আস্ত শুপারি এবং বিয়ে পড়ানোর পর ঝালের লাড়– যা গ্রামের মাতব্বরের নিকট আয়-দায় হিসেবে বুঝে দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে মোল্লার বিয়ে পড়ানোর খরচ বাবদ টাকা, এলাকার মসজিদ, মাদরাসা, গোরস্থান এবং যুবকদের সমিতি বা ক্লাবের জন্য নগদ টাকাও তার হাতে বুঝে দিতে হলো। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।