ফেলে আসা দিন গুলো -১৩

এবাদত আলী
তখন রাধানগর মজুমদার একাডেমি (আরএম একাডেমি) হতে সবেমাত্র এসএসসি পাশ করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি। আমার সহপাঠি বন্ধু আটঘরিয়ার নজরুল ইসলাম রবি, (বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল, ডি জি এফ আই এর সাবেক ডিজি), নাটোরের কেএম মোনায়েম (স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ), শরিফ উদ্দিন শরিফ (ইশ্বরদীর চরকামালপুর হাই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক, মৃত), নুরুল ইসলাম নুরু (বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পাবনা সদর থানার প্রথম থানা কমান্ডার, (মৃত), গোলাম সরওয়ার খান সাধন (স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ), আব্দুর রশিদ বিশ্বাস (সাবেক প্রধান শিক্ষক দেবোত্তর কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়), মিরজাউল হোসেন তারা (আমেরিকা প্রবাসী) সহ অন্যান্যরা মিলে ‘রাধানগর ধ্রুবতারা সংঘ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাধানগর ধ্রুবতারা সংঘের পক্ষ থেকে পাবনা বনমালীতে প্রসাদ বিশ্বাস রচিত ‘জবাবদিহি’ নাটক মঞ্চস্থ করা হবে মর্মে বেশ জোরে শোরে নাটকের মহড়া শুরু হলো। এডওয়ার্ড কলেজের লাইব্রেরিয়ান আবু তায়েব শামসুল হুদা সাহেবের সহযোগিতায় কলেজ প্রিন্সিপালের অনুমতিতে লাইব্রেরির পাশের একটি রুমে নাটকের রিহার্সেল বা মহড়ার ব্যবস্থা করা হয়। লাইব্রেরির পিয়ন মোজাম্মেল হক আমাদেরকে অনেক সহযোগিতা করেন। সারাদিন ডিউটি করার পর ঢের রাত অবধি তিনি সেখানে উপস্থিত থাকতেন
নাটকের পরিচালক শরিফ উদ্দিন। প্রোমটার বা স্মরণ সহায়তায় সহযোগিতা করলেন আলাউদ্দিন মাষ্টার। এসময় নাটক কিংবা যাত্রাপালায় নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কোন মেয়ে পাওয়া যেতনা। তাই গোঁফ-দাড়ি বিহীন মাকুন্দা টাইপের সুদর্শন ছোকরাদেরকে শাড়ি-ব্লাউজ পরিয়ে পরচুলা লাগিয়ে নারীর ভুমিকায় অভিনয় করানো হতো। এমন উৎসাহি ছোকরাও পাওয়া গেল। একজন আমার সহপাঠি নব কুমার, (ছদ্ম নাম), অন্যজন আরএম একাডেমির ছাত্র আবুল কাজেব (ছদ্ম নাম)।
দীর্ঘদিন ধরে মহড়া দেওয়ার পর নাটক মঞ্চায়নের জন্য দিনক্ষণ ঠিক করা হলো।
বনমালী হল ভাড়া করা হলো। পাবনা টাউন হলের পিছনে বনমালী ইনস্টিটিউটের হল রুমে নাটকটি মঞ্চস্থ করা হবে মর্মে সারা শহর ও শহরতলীতে মাইক দ্বারা প্রচার করার ব্যবস্থা করা হলো। কার্ড ছাপিয়ে সুধিজনদেরকে আমন্ত্রণ জাননো হলো। প্রধান অতিথি হিসেবে নাটকটির উদ্বোধন করবেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের প্রিন্সিপাল আমিনুল হক। সেই সাথে অন্যান্য শিক্ষক মন্ডলি এবং ছাত্র লীগের নেতা-কর্মীদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো।
১৯৬৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে মঞ্চস্থ হওয়া উক্ত নাটকে আমি হাস্যরস চরিত্র পিতাম্বরের ভূমিকায় অভিনয় করি।
এই নাটক মঞ্চায়নের খবর ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘চিত্রাকাশ পত্রিকা’র পাবনাস্থ প্রতিনিধি টিআইএম রিয়াজুল করিম হিরোক তা উক্ত পত্রিকায় প্রকাশ করেন। প্রকাশিত খবরটি ছিলো নি¤œরূপ:- ‘‘গত ২৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয় বনমালী রঙ্গমঞ্চে রাধানগর ধ্রুবতারা সংঘের প্রযোজনায় তাদের প্রথম নাট্য অবদান প্রসাদ বিশ্বাস রচিত সামাজিক নাটক জবাবদিহি মঞ্চস্থ হয় রাত্রী ৮.৩০ মিনিটে। নাটকটি পরিচালনা করেন শরীফ আহমদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল হক।
জবাব দিহি ধ্রুবতারা সংঘের প্রথম অবদান, তাছাড়া প্রায় সমস্ত শিল্পীরই প্রথম মঞ্চবতারণ, তাই এ নাটকের ভুলত্রুটির সমালোচনা করতে চাইনা অতি দুরের দৃষ্টিকোণ থেকে। তাই নিঃসন্দেহে তাদের এ প্রচেষ্টাকে সার্থক বলা যেতে পারে। তবে এই নাটকের অভিনয় ছাড়া অন্য যে সমস্ত ত্রুটি অভিজ্ঞ লোকদের হাত দিয়ে ঘটেছে তা ক্ষমাহীন ভাবেই তুলে ধরছি। পাবনার সবে ধন নীলমণি রূপ সজ্জাকর জনাব আয়েন উদ্দিন রূপ সজ্জায় আগাগোড়াই ব্যর্থতার পরিচয় বহন করে আসছেন। শিল্প নির্দেশনা ও মঞ্চসজ্জায় যে লোকগুলো ছিলো তাদের ভূমিকা ঠিক বুঝতে পারলামনা। তারা কেবল নাম প্রচারের ইচ্ছা ত্যাগ করে যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে নাটকটি যে আরো প্রাণবন্ত হতে পারতো তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। আলোক সজ্জাতে তপন কুমার কোন নতুনত্ব দেখাতে পারেননি। সঙ্গীত পরিচালক বেতার শিল্পী হাসানুজ্জামান তালুকদার অনুষ্ঠানে সারাক্ষণ অনুপস্থিত থাকা সত্তেও তাঁর নাম বিভিন্ন ভাবে ঘোষণা করার কোন অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলামনা। কণ্ঠ সঙ্গীতে গোলাম সরওয়ার খান সাধন অপু;র্ব কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অংশ নেন অমলেন্দু কুমার, নুরুল ইসলাম নুরু, নজরুল ইসলাম রবি, এবাদত আলী, আব্দুস সাত্তার, ইকরামূল হক, মোনায়েম, শওকত হোসেন স্বপন, মঙ্গল কুমার, শরীফ উদ্দিন, আবুল কাসেম প্রমুখ শিল্পীগণ। পরিচালনা সার্থকতার দাবিদার। আগামীতে রাধানগর ধ্রুবতারা সংঘের কাছ থেকে আরো সার্থক নাটক আশা করি।’’

(চলবে)

(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।