কমলগঞ্জে ১৮০ তম মণিপুরী রাস উৎসব

মশাহিদ আহমদ, মৌলভীবাজার ঃ চন্দ্র মাসের প্রথম দিনে যেদিন সন্ধ্যার আকাশে হেসে উঠেছিল এক চিলতে চাঁদ, সেদিন আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল মণিপুরীরা। এ পক্ষেই যেদিন আকাশের কোল জুড়ে হেসে উঠবে পূর্ণিমার চাঁদ, সেদিন মণিপুরীরা মেতে উঠবে রাস উৎসবে। কমলগঞ্জে অনুষ্টিত হয়ে গেল গত ৮ নভেম্বর ১৮০ তম মণিপুরী রাস উৎসব। মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা। সকালে মাধবপুরে শিববাজার ও জোড়ামন্ডপে রাখাল নৃত্য মধ্য দিয়ে এ উৎসব শুরু হয়। রাতে হয় উৎসবের মূল পর্ব মহারাসলীলা দৃত্য। অন্য দিকে আদমপুরে তেতইগাঁও সানাঠাকুর ম-পে মণিপুরী মৈ-তৈ সম্প্রদায় এবার ৩৭ তম রাসোৎসব উদযাপন করে। এ উৎসব উপলক্ষে উভয় স্থানে বসেছিল মেলা। আর এ উৎসবকে ঘিরে পুরো এক মাস জুড়েই মণিপুরী অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুর মণিপুরী পাড়ায় ঘরে ঘরে চলছিল উৎসবের প্রস্তুতি। রাস উৎসবে স্থানীয় ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন তো বটেই, সুদূর ভারত থেকেও ছুটে এসেছিলেন সেখানকার মণিপুরীরা। সাদা কাগজের নকশা আর নানান ফুলের আবরণে সজ্জিত ম-পগুলো কী এক অমোঘ আকর্ষণে রাতভর ধরে রেখেছিল হাজারো মানুষকে। আর সেই সাথে মণিপুরী মেয়েদের নৃত্য সবার মনে ছড়িয়েছিল মূগ্ধতা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার লোকজন রাতভর মেতে উঠেছিল এই আনন্দ উৎসবে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞাণী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল উৎসব অঙ্গন। জানা গেছে- মণিপুরীদের এই মহারাস বলতে প্রেমরসকেই বোঝায়। বস্তুত রস শব্দ থকেই রাস শব্দটির উৎপওি। রস আশ্বাদনের লক্ষ্যে এই পূর্ণিমা তিথিতে রাধা-কৃষ্ণের লীলানুকরনে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে মণিপুরীরা যে উৎসব করে থাকে, তা-ই রাস উৎসব। ১৭৭৯ সালে মনিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নদৃষ্ট হয়ে এই নৃত্যগীতের প্রর্বতন করেছিলেন। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাগনের বেশরিভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশগ্রহণ করতেন। ১৮৪২ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়াম-পে মহারাসলীলা শুরু হয়। যা এখনো চলছে। এটি এখন এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মনিপুরীদের রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মনিপুরী নৃত্য শিক্ষা। মনিপুরী এ নৃত্যকলা এখন শুধু কমলগঞ্জের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।