ফেলে আসা দিন গুলো- ১২

এবাদত আলী
পাবনা রাধানগর মজুমদার একাডেমিতে (আরএম একাডেমি) ভর্তি হবার পর আমার বড় খালার বাড়ি মনোহরপুরে জায়গির থাকতাম। এরপর লেখাপাড়ার বেশি সুবিধাজনক পরিবেশের জন্য পাশের গ্রাম গোপালপুর আমার খালাতো বোনের বাড়ি আমার লজিং বা জায়গিরের ব্যবস্থা হলো। এই বাড়ির উত্তর পাশে গোপালপুরের জোলার পাড়ে একটি প্রকান্ড তেঁতুল গাছ থাকায় ঐ বাড়ির নাম ছিলো তেঁতুলগাছওয়ালা বাড়ি। তেঁতুল গাছের জন্য ঐ বাড়ির মালিকের নাম কেউ যেমন সহসা বলতোনা ঠিক তেমনি এলাকায় আমার নামও হয়েছিলো তেঁতুল গাছওয়ালা বাড়ির মাস্টার। কোন স্কুলে শিক্ষকতা না করেও আমরা খেতাব পেয়েছিলাম মাস্টার। অর্থাৎ যারা জায়গির থকাতো তাদেরকে বলা হতো অমুক ছাত্র অমুকের বাড়ির মাস্টার।
গোপালপুর গ্রামের লাগোয়া গ্রাম ছিলো বাহাদুরপুর, আফুরি, বৈকুন্ঠপুর ও চকচিরোট। আমার জায়গির বাড়িটি ছিলো ঠিক মাঝামাঝি স্থানে। তাই ঐসকল গ্রামে আমার মত যারা জায়গির থাকতেন তারা প্রায়ই আমার এখানে আসতেন। আমিও তাদের জায়গরি বাড়িতে যেতাম। ফলে আমাদের সকলের মাঝে সখ্যতা গড়ে ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যেসকল ছেলেরা লেখাপড়া করতো তাদের সাথেও মাস্টারদের ছিলো নিবিড় বন্ধুত্ব। এক কথায় আমরা লেখাপড়ার অবসরে সকলে মিলে চুটিয়ে আড্ডা দিতাম।
আড্ডা দেওয়ার জন্য আমার জায়গির বাড়ি ছিলো সম্পপুর্ণ অনুকুূল। আমার ভগ্নিপতি গহের প্রমানিক মৃত্যবরণ করায় এবাড়ির গার্জিয়ান ছিলেন আমার বোনের শাশুড়ি অর্থাৎ গহেরের মা। তিনি আমাকে খুব ¯েœহ করতেন। আমি ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করতাম আর তিনি সেকারণে আমাকে পুর্ণ স্বাধীনতা দিতেন। আমি কোন আড্ডা দিলেও তার কাছে সেটা ভালো কাজ বলে তিনি ধরে নিতেন। কোনদিন ফিরতে অনেক রাত হলে তিনি বলতেন আমাদের মাষ্টার আজ হয়তো সভা (জালছা) শুনতে গেছে। আমি সিনেমা দেখতে গেলেও তিনি বিশ্বাস করতেননা। বলতেন আমাদের মাষ্টার কোনদিন সিনেমা বাইস্কোপ দেখতে পারেনা।
গোপালপুরে জায়গির থাকার সুবাদে এলাকার যুবসমাজের সঙ্গে ঘনিষ্টতার কারণে এই এলাকায়‘‘ আলোক সমিতি ’’ নামে একটি সমিতি গঠন করা হয়। সকলে মিলে আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। সভাপতি হলেন চকচিরোট গ্রামের মোঃ হারেজ আলী (টেবুনিয়া ওয়াছিম পাঠশালার সাবেক প্রধান শিক্ষক, বর্তমানে মৃত)। আলোক সমিতির কার্যকরি কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৭জন। সকলে মিলে একটি নাটক মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। নাটকের নাম “দাদুর স্বপ্ন”। মুলতঃ এটি নাটিকা। নারি চরিত্র বর্জিত এই নাটিকা মঞ্চস্থ করা হয় চকচিরোট আকবর মেম্বরের বাড়ির আঙিনায়। নাটকটি পরিচালনার ভার পড়ে আমার উপর। এতে অভিনয় করেন হারেজ আলীর ভাতিজা মোঃ হাসানুজ্জামান হেলাল, আমিন উদ্দিন ও গোপালপুরের কোবাদ আলী (পাবনা থিয়েটার ‘৭৭ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও নাট্যাভিনেতা) প্রমুখ।
কথায় বলে দুধের সাধ ঘোলে মেটেনা। দাদুর স্বপ্ন নাটিকা মঞ্চস্থ করে আমরা পড়লাম বিপদে। এলাকার লোকজন বড় নাটক এবং সত্যিকারের নাটক দেখতে চায়। এলাকার মানুষের মন যোগাতে আমরা আলোক সমিতির অফিসে মিটিংএ বসে সিদ্ধান্ত নিলাম নাটক মঞ্চস্থ করার। এবারে নাটকের পরিচালক হারেজ আলীর খালাতো ভাই ঈশ্বরদী জিন্নাহ কলেজের ছাত্র, পাবনা শহরের শাহজাহান আলী আন্টু। (পরে ঢাকা এফ ডি সির নবরাগ বাণীচিত্রের পরিচালক, বর্তমানে মৃত)। তিনি একটি নাটকের বই নিয়ে এলেন নাম “শেষফল”। নাটকটি সবারই পছন্দ। মঞ্চস্থ করলে এলাকার লোকজন খুবই খুশি হবে। কিন্ত গোল বাধলো অন্যখানে। এই নাটকে দুটি নারী চরিত্রে অভিনয় করবে কে। এসময় নাটক কিংবা যাত্রাপালায় নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কোন মেয়ে পাওয়া যেতনা। তাই গোঁফ-দাড়ি বিহীন মাকুন্দা টাইপের সুদর্শন ছোকরাদেরকে শাড়ি-ব্লাউজ পরিয়ে পরচুলা লাগিয়ে নারীর ভুমিকায় অভিনয় করানো হতো।
তাও ছিলো দুষ্প্রাপ্য। শাড়ি – ব্লাউজ হয়তো পরতে চাইতো, কিন্তু নারী সাজতে গেলে নারকেলের মালই দিয়ে যখন স্তন বানিয়ে তা বুকের উপর লাগিয়ে দিতে চাওয়া হতো তখন লজ্জা শরমের কারণে কিছুতেই রাজি হতে চাইতোনা। এ নিয়ে তাকে অনেক নছিহত করা এবং হাত খরচের জন্য কিছু টাকা পয়সা দেওয়ার আশ্বাসে কেবল রাজি হতো। শেষফল নাটকে দুটি নারী চরিত্র। পুলিশ অফিসারের বোন নাজনীনের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এলাকার ছেলে ইজ্জত আলী (ছদ্ম নাম) রাজি হলো। কিন্তু নায়িকার চরিত্রে কোন ছোকরা পাওয়া গেলনা। অগত্যা উদীয়মান কন্ঠশিল্পী আরএম একাডেমির এক ছাত্র (আবুল কাজেব, ছদ্ম নাম, (বর্তমানে রাজশাহী বেতার শিল্পী) নায়িকার ভুমিকায় অভিনয় করার জন্য রাজি হলো।
মহড়া শেষ করে নির্ধারিত রাতের বেলা চকচিরোট হারেজ আলীর বিরাট খোলার উপর নাটক মঞ্চস্থের আয়োজন। এবাড়ি ওবাড়ি হতে চৌকি জোগাড় করে নাটকের মঞ্চ তৈরি করা হলো। নাটকের মঞ্চ ঘেরাসহ নারী চরিত্রে অভিনয় কারিদের জন্য গ্রামের বিভিন্ন মহিলাদের নিকট হতে পরনের শাড়ি জোগাড় করা হলো। দর্শক ¯্রােতাদের বসার জন্য পাবনা শহর হতে বাঁশের চাটাই ভাড়া, স্থানীয়ভাবে ধানের খড় বা বিচালি এবং মাছ ধরার বানা বিছিয়ে দেওয়া হলো।
পাবনার একমাত্র পেইন্টার বা রূপসজ্জাকারি আয়েন উদ্দিনকে আনা হলো। তিনি পরচুলাসহ নারী চরিত্রের জন্য অন্যান্য সামগ্রির জোগান দিলেন। পাবনা শহরের “হেদায়েত মাইক সার্ভিস” হতে মাইক সেট এবং হ্যাজাক লাইট, ডে-লাইট ভাড়া করে আনা হলো। অতি কষ্টে পুলিশের পোষাকও জোগাড় হলো। হারমোনিয়ম, ডুগি তবলা, ফলুয়েট বাঁশিসহ বাদ্যকরগণ ঈশ্বরদী হতে জোগাড় করলো পরিচালক।
নাটকের পরিচালক নাটক শুরুর আগে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে স্লাইডে নাটকের নাম, নাটক রচয়িতার নাম, অভিনয় শিল্পী ও কলা কুশলিদের নাম, প্রযোজক পরিচালকের নামসহ কৃতজ্ঞতা স্বীকারসহ সকল নামধাম সিনেমার পর্দার মত একটি বড় পর্দায় দেখালেন। হাজারো নারী-পুরুষ দর্শকের উপস্থিতিতে নাটকটি শুরু হলো কিন্তু দর্শক সমাগম বেশি হওয়ায় নাট্য শিল্পীদের কথা বা ডায়ালগ শুনতে না পারার কারনে হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। অগত্যা পরিচালকের বুদ্ধিমত্বায় নাটকের ডায়ালগ যাত্রাপালার ডায়ালগের মত উচ্চস্বরে বলায় পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং শেষফল নাটক শেষফল ’ যাত্রাপালা হিসেবে শেষ হয়। এতে দর্শক ¯্রােতাগণ খুশি মনে বাড়ি ফেরে যায়। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
তাং ০৯/ ১১/২০২২