একশ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে এক হাজার বর্গ কিলোমিটার!

ইকবাল কবীর রনজু, চাটমোহর (পাবনা)

বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল। বিষুব রেখার ২৪ ডিগ্রী ৭ মিনিট থেকে ২৪ ডিগ্রী ৩৫ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯ ডিগ্রী ১০ মিনিট থেকে ৮৯ ডিগ্রী ৩৫ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে চলনবিলের অবস্থান। ধারণা করা হয়, চলনবিলের পানি নদীর ¯্রােতের মতো চলন্ত বা গতিশীল ছিল বলে এ বিলের নামকরণ করা হয় চলনবিল।

১৯১৯ সালে প্রকাশিত ইম্পেরিয়াল গেজেট অব ইন্ডিয়ার রাজশাহী অংশে বলা হয়েছে চলনবিলের মোট আয়তন ৫৫০ বর্গমাইল বা ১৪২৪.৫ বর্গ কিলোমিটার। পূর্ববঙ্গ রেলওয়ে কর্তৃক ১৯৪০ সালে প্রকাশিত “বাংলার ভ্রমণ” গ্রন্থ সূত্রে জানা যায় এ বিলের আয়তন ৪৪১ বর্গমাইল বা ১১৪২.১৮ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্থে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ চলন বিলের আয়তন লিখেন ৮০০ বর্গমাইল বা ২০৭২ বর্গ কিলোমিটার। ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর আয়োজনে ২০২৫ সালের ১২ এপ্রিল পাবনার চাটমোহরের ডায়মন্ড হোটেলের হলরুমে চলনবিলের পরিবেশ সংকট ও সামাজিক আন্দোলন শীর্ষক এক আলোচনা সভায় চাটমোহর সরকারি কলেজের ভূগোল বিষয়ের প্রভাষক ড.এস.এম মুক্তি মাহমুদ তার প্রবন্ধে উপস্থাপন করেন বর্তমানে চলনবিলের আয়তন মাত্র ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার। ৪ জেলার ১২ উপজেলার ৬২ ইউনিয়ন ও ৮ টি পৌরসভার ১.৬০০ গ্রাম চলনবিলের অন্তর্ভূক্ত।

ড.এস.এম মুক্তি মাহমুদের প্রবন্ধানুসারে গত প্রায় একশ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার। সর্বশেষ তথ্যের সাথে তুলনা করলে, ইম্পেরিয়াল গেজেট অব ইন্ডিয়ার তথ্যানুসারে ১০৬ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ১০৭৪ বর্গ কিলোমিটার। “বাংলার ভ্রমণ” গ্রন্থ মতে গত ৮৫ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ৭৯২ বর্গকিলোমিটার এবং অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের তথ্যানুসারে ৫৮ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ১৭২২ বর্গকিলোমিটার। মতান্তর থাকলেও উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণে চলনবিলের আয়তন যে ক্রমাগত আশংকাজনক হারে কমছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

১৯৬৭ সালে প্রকাশিত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, দুই হাজার বছর আগে চলনবিল নামে কোন জলময় ভূভাগ ছিল না। তখন এ বিল ছিল সমুদ্র গর্ভে। কিছুকাল পর সমুদ্র চলনবিলকে জন্ম দিয়ে দক্ষিণে সরে যায়। পদ্মা ও যমুনা ধাত্রী রূপে শিশু চলনবিলকে ধারণ করে। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে চলনবিলের কোন কোন অঞ্চলে পলি জেগে ওঠায় লোকবসতি শুরু হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত রাজাদের রাজত্বকালের নিদর্শন পাওয়া যায় চলনবিলে। বৌদ্ধ যুগে চলনবিল অঞ্চল পৌন্ড্রবর্দ্ধন বিভাগের অন্তুর্ভুক্ত ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে আদিশূরের রাজত্বকালে চলনবিল অঞ্চল গৌড় রাজ্যের ভর এলাকার অন্তর্ভূক্ত হয়। পাল ও সেন আমলে চলনবিল অঞ্চল বরেন্দ্র বিভাগের অন্তর্ভূক্ত ছিল। লেখক প্রমথ নাথ বিশীর উদ্ধৃতি দিয়ে মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ তার এ গ্রন্থে লেখেন, চারশত বছর পূর্বে চলনবিল রাজশাহী পাবনা বগুড়ার অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিরাজ করতো।

বিদেশী সফরকারীরা এক সময় চলনবিলের বিস্তৃতি দেখে বিস্ময়াভিভুত হয়েছেন। এখন থেকে এক দেড়শ বছর পূর্বেও জনবসতি এলাকা ছাড়া চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল পাঁচশ বর্গ মাইলের উপরে। পাবনা, নাটোর, নওগা, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার দক্ষিণাঞ্চল চলনবিলের অন্তর্ভূক্ত ছিল।

বর্তমানে নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম পাবনা জেলার চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও সলঙ্গা এ আটটি থানা এবং উল্লাপাড়ার দক্ষিণ পশ্চিমের দশটি ইউনিয়ন জুড়ে চলনবিল অবস্থান করছে। ১৯১৪ সালে সাড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন স্থাপিত হওয়ার পর এ রেললাইনের উত্তর-পশ্চিম অংশ চলনবিল নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের বৃহত বিল চলনবিলের আয়তন কমার অন্যতম প্রধান কারণ নদি বাহিত পলি মাটি। নদী পথে প্রতি বছর ২২২.৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি চলনবিলে প্রবেশ করে। ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বিল থেকে রবড়িয়ে যায়। প্রতি বছর ১৬৯.৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বিলে জমা হয়। এছাড়া বিলের মধ্য দিয়ে সড়ক পথ, রেলপথ নির্মাণ, ব্রিজ, কালভার্ট, স্লুইজগেট, ইট ভাটা, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, ময়লা আবর্জনা জমে ও অবৈধ দখল ক্রমশই এক সময়ের চলন্ত বিল চলনবিলকে সংকুচিত করছে। এ এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল, খাঁড়িও নাব্যতা হারিয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পরছে চলনবিল এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায়।

অতীতে চলনবিল এলাকার মানুষ কৃষি ব্যবসা বানিজ্য মৎস শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলনবিলের পানির উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু চলনবিল এলাকার অধিকাংশ নদ-নদী মৃতপ্রায় অবস্থায় উপনীত হওয়ায়, বিল, খাল, খাঁড়ির নাব্যতা সংকটে ভোগায় একসময়ের চলন্ত বিল চলনবিল আজ মরা বিলে পরিণত হয়েছে। বিলের বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত স্লুইজগেট অনেক বিলকে নিয়ন্ত্রিত বিলে পরিণত করেছে।

একসময় এসব নদী বিল খাল খাঁড়ির পানিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচ কার্য হত। নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। জমিতে ভাল ফসল উৎপাদন হতো। ব্যবসা বানিজ্যের অবস্থা ও ভাল ছিল। সড়ক পথ হওয়ায় মানুষ সড়ক পথে পণ্য পরিবহন করতে পারলেও তা ব্যয়বহুল। বর্তমান সময়ে চলনবিলের সবগুলো নদী বছরের অর্ধেকের বেশি সময় পানি শূণ্য থাকে। ব্যহত হচ্ছে সেচ কার্য, ফসল উৎপাদন। ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে অনেক ফসলের জাত।

মৎস ভান্ডার খ্যাত চলনবিল আজ মাছ শূণ্য হওয়ার পথে। পানি স্বল্পতাসহ চায়না জাল, কারেন্ট জাল, স্বোতী জালসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বাড়ায় ইতিমধ্যেই বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খোদ চলনবিলের মানুষই ভুলতে বসেছে নদী খাল বিলের দেশী মাছের স্বাদ। খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙ্গে পড়ায় বিলুপ্ত হচ্ছে জীব বৈচিত্র, প্রাণ পকৃতি। বছরের অধিকাংশ সময় বেকার সময় কাটান এ এলাকার প্রায় ৭৫ হাজার জেলে। বাধ্য হয়ে ইতিমধ্যে পেশা পরিবর্তন করেছেন অনেকেই।

চলনবিল রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীর আলম জানান, চলনবিলের আয়তন কমায় চলনবিলের পরিবেশ সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করছে। পানির অভাবে চলনবিল এলাকার মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবত নদী খনন না করায় পলি পরে নদীর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহারের কারণে পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। চলনবিল এলাকা ক্রমান্বয়ে মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চলনবিলের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সঠিক নিয়মে মৃতপ্রায় নদ-নদী খনন, নদী পথের প্রতিবন্ধকতা অপসারণ, দখল, দূষণ বন্ধে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সদস্য সচিব শরীফ জামিল জানান, চলনবিল যে শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থে রক্ষা করা দরকার তা নয়, সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলকে লবনাক্ততার হাত থেকে রক্ষা করতে চলনবিলের নদ নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ করা জরুরী। সরকার এই অমূল্য সম্পদ স্থানীয় মানুষকে সাথে নিয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ না নিলে শীঘ্রই চলনবিল অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে।