গৃহহীনদের মামলায় পলাতক ইউপি চেয়ারম্যান, কারাগারে পিএস নুরুল

মো. আখলাকুজ্জামান, নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
নাটোরের গুরুদাসপুরের ইউপি চেয়ারম্যান শওকত রানা লাবু ও তাঁর ব্যক্তিগত (পিএস) নুরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার ঘর নির্মাণ করে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এলাকার ভূমি ও গৃহহীন দিনমজুর মানুষদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এদিকে ঘর না পেয়ে ৫০ হাজার টাকা ফেরত না দেওয়ার ঘটনায় চেয়ারম্যান লাবুসহ নুরুলের বিরুদ্ধে গুরুদাসপুর থানায় প্রতারণা মামলা দায়ের করেছেন ওই ইউনিয়নের জালাল উদ্দিন নামের এক ভুক্তভোগি। মামলার প্রেক্ষিতে থানা পুলিশ ২নং আসামী নুরুল ইসলামকে গ্রেফতার করলেও প্রধান আসামী ইউপি চেয়ারম্যান লাবু গা ঢাকা দেওয়ায় তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। ফলে চেয়ারম্যান সমর্থকদের হুমকি ধামকিকে উপেক্ষা করে হামলার আশঙ্কার মধ্য দিয়ে দিনরাত কাটাচ্ছেন ভুক্তভোগিরা। চেয়ারম্যানসহ তার কর্মি জামিনে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ খুঁজছেন বলেও জানিয়েছে থানা পুলিশ।
শনিবার সকালে সরেজমিনে জানা যায়, উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ২০১৭-১৮ইং অর্থবছরে নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদে গৃহহীনদের বাসস্থান তৈরির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ বরাদ্দ দেওয়া হয়। উপহারটি হলো ‘আধাপাকা টিনসেড ঘর’। সেই ঘর পাওয়ার আশায় ওই ইউনিয়নের চন্দ্রপুর গ্রামের ডুবারপাড়া আদিবাসী পল্লীর চারজন সংখ্যালঘু শংকরী বালা ২৫ হাজার টাকা, সুদেপ ওরাও ৮০ হাজার টাকা, বীরেন্দ্রনাথ ৪৫ হাজার টাকা ও প্রদীপ কুমার ৮৫ হাজার টাকা তাদের প্রতিবেশি রতন কুমারের মাধ্যমে চেয়ারম্যান লাবুর পিএস নুরুলের হাতে জমা দেন। আড়াই বছর হলো টাকা দিয়েও তারা ঘর পাননি। ফলে ১৭ নভেম্বর ইউপি চেয়ারম্যান লাবু ও তার ডান হাত নুরুল ইসলামের কাছে ঘরের টাকা ফেরত চাইলে না দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে গুরুদাসপুর থানায় আরো ৩টি প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলে জানান ওই সংখ্যালঘু হতদরিদ্ররা।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, ওই ইউনিয়নের চন্দ্রপুর গ্রামের মৃত মকছেদ শেখের হতদরিদ্র ছেলে জালাল উদ্দিনকে এলাকাবাসীর সামনে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ‘ঘর’ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন ইউপি চেয়ারম্যান লাবু ও কর্মি নুরুল। নুরুল ইসলামের মাধ্যমে চেয়ারম্যানের কাছে ৫০ হাজার টাকা জমা দেন তিনি। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও ঘর দেননা চেয়ারম্যান। পরে ঘরের টাকা ফেরত চাইতে গেলে জালালকে টাকা দিতে অস্বীকার করেন চেয়ারম্যান লাবু। এ ঘটনায় ১৭ নভেম্বর ভুক্তভোগী গৃহহীন দিনমজুর মো. জালাল উদ্দিন গুরুদাসপুর থানায় এসে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশি তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে মঙ্গলবার ১ ডিসেম্বর চেয়ারম্যান লাবু ও তার ডান হাত নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে থানায় প্রতারণা মামলা রুজু হয়। ৩ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার পুলিশ ওই মামলার ২নং আসামী নুরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে নাটোর জেল হাজতে প্রেরণ করে। এরপর থেকেই চেয়ারম্যান শওকত রানা লাবু গা ঢাকা দেন। তবে নুরুলের বিরুদ্ধে পুকুরের মাছ চুরির মামলাও রয়েছে এবং নাটোর আদালতেও আরো একটি চাঁদাবাজির মামলা রুজু আছে ইউপি চেয়ারম্যান লাবুর বিরুদ্ধে। রানীগ্রামের আনসার আলীর ছেলে শাহিনকে ইউনিয়ন পরিষদে আটকে রেখে চাঁদা দাবি করেন চেয়ারম্যান লাবু ও তার কর্মিরা। ঘটনাটি পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ঘর উপহার পেয়েও ভুক্তভোগি ওই এলাকার প্রদীপ কুমার জানান, কম খরচে ইটের দেয়াল, পাকা মেঝে, টিনের চাল, টিউবওয়েলসহ ঘর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে নুরুলের মাধ্যমে চেয়ারম্যান লাবুর হাতে আমি ৮৫ হাজার টাকা দেই। দুই বছর পরে এসে ঘরের মেঝে আর টিনের চালা ছাড়া আর কিছুই পাইনি। আমি আমার টাকা ফেরত চাই, নয়তো বাসযোগ্য ঘর চাই।
অপরদিকে ভুক্তভোগি সুদেপ ওরাও, বীরেন্দ্রনাথ, প্রদীপ কুমার, শংকরী বালাসহ কয়েকজন সংখ্যালঘু বলেন, সরকারের ঘর দেওয়ার খবর শুনে আমাদের প্রতিবেশি রতন দাদাকে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে খোঁজ নিতে বলি। পরিষদে গেলে ইউপি চেয়ারম্যান লাবু বলেন হ্যা ঘর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ঘরের জন্য কিছু টাকা লাগবে বলে জানান চেয়ারম্যান। রতন দাদা এসে টাকার বিষয়টি আমাদের সবাইকে বলেন। চেয়ারম্যানকে বিশ^াস করে আমাদের সামর্থ অনুযায়ী টাকাগুলো দিয়েছিলাম। আড়াই বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত ঘর পাইনি টাকাও ফেরত পাইনি। টাকা ফেরত চাইতে গেলে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে হুমকিধামকি দিয়ে আমাদের তাড়িয়ে দেন চেয়ারম্যান ও তার পিএস। এমতাবস্থায় সুষ্ঠু বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রশাসনের কাছে জোর অনুরোধ জানিয়েছেন সংখ্যালঘুরা।
প্রতিবেশি রতন কুমার বলেন, চেয়ারম্যান লাবু ও তার পিএস নুরুলের দাবির প্রেক্ষিতে আমাকে এলাকার চারজন সংখ্যালঘু গরিব গৃহহীন মানুষ টাকাগুলো চেয়ারম্যানের ডান হাত নুরুলের কাছে দিতে বলেন। আমি নুরুলের কাছে টাকাগুলো জমা দেই। কিন্তু আড়াই বছরেও যখন দেখলাম ঘর পেলাম না তখন আমার মনে সন্দেহ জাগে। তাই টাকা ফেরত চাই চেয়ারম্যান ও তার পিএস’র কাছে। কিন্তু তারা টাকা না দিয়ে উল্টো ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আমাদেরকে বিতারিত করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। এখন সুষ্ঠু বিচার পেতে সরকার আর প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতেই এই সমস্যা সমাধান হওয়া সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
পিবিআই’র পুলিশ পরিদর্শক মো. নাসিরুল ইসলাম বলেন, লাবু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলার তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। তদন্ত শেষে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তমাল হোসেন বলেন, চেয়ারম্যান শওকত রানা লাবুর বিরুদ্ধে গুরুদাসপুর থানায় প্রতারণা মামলা দায়ের হয়েছে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়টি আমি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
গুরুদাসপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল রাজ্জাক বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, চেয়ারম্যান লাবুসহ নুরুল ইসলামের নামে প্রতারণা মামলা হয়েছে। নুরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে নাটোর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে চেয়ারম্যান লাবুর জামিন নেওয়ার কথা। তাঁকেও পুলিশ খুঁজছে।
পরিলক্ষিত হয় যে, ইতিপূর্বেও সরকারি ঘর দেওয়ার কথা বলে নাজিরপুর ইউনিয়নের মামুদপুর গ্রামের নুর মোহাম্মাদের ২৫ হাজার টাকা ও ইয়াসিন আলীর কাছে থেকে ২৫ হাজার টাকা নেয় চেয়ারম্যান লাবুর কর্মি ফিরোজ। ঘর না দিয়ে তিন বছর ধরে তাদেরকে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে হয়রানি করে আসছিল ফিরোজ। শেষ পর্যন্ত টাকা ফেরত না দেওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান লাবুর বিরুদ্ধে ঘর দেওয়ার নামে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বক্তব্যসহ ভিডিও প্রকাশ করেন নুর মোহাম্মাদ। পরে সাংবাদিক আসার খবর শুনে ওইদিনই ভুক্তভোগিদের টাকা ফেরত দেন ইউপি চেয়ারম্যান শওকত রানা লাবু। সেই সাথে নুর মোহাম্মাদকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে তার মুখ থেকে চেয়ারম্যানের পক্ষে কথা বলিয়ে তা ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ইউপি চেয়ারম্যান লাবুর বিরুদ্ধে কেউ কোনো দুর্নীতি তুলে ধরে তা ইন্টারনেটে ছাড়লে চেয়ারম্যানের কর্মিরা ভুক্তভোগিদের ম্যানেজ করে এভাবেই চেয়ারম্যানের পক্ষে বক্তব্য নিয়ে তার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন ওই ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. আইয়ুব আলী প্রামাণিক।