২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়ছে। পৃথিবী জুড়ে মানুষ আতঙ্কের মধ্য দিয়ে পার করেছে দুঃস্বপ্নের প্রায় একটি বছর। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশেও। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে পুরোপুরি বা শহরভিত্তিক কঠোর লকডাউন ও কারফিউ শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশেও করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণে এশিয়ায় শীর্ষ পাঁচে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশে গত এক দিনে আরো ২ হাজার ১৩৯ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যা গত ৭০ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে এর চেয়ে বেশি নতুন রোগী শনাক্তের খবর এসেছিল গত ৭ সেপ্টেম্বর। সেদিন ২ হাজার ২০২ জন রোগী শনাক্তের তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর দীর্ঘদিন শনাক্ত ২ হাজারের নিচে ছিল। গতকাল শনাক্ত ২ হাজার ছাড়িয়ে গেল।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুসারে, করোনার সংক্রমণে এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ভারত, দ্বিতীয় স্থানে ইরান, তৃতীয় স্থানে ইরাক, চতুর্থ স্থানে ইন্দোনেশিয়া এবং পঞ্চম স্থানে বাংলাদেশ। এছাড়া ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে তুরস্ক এবং সপ্তম স্থানে ফিলিপাইন। কেবল পশ্চিমা দেশেই নয়, বাংলাদেশেও দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান আসছে বিভিন্ন মহল থেকে। আসন্ন শীতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার আশঙ্কা আছে।
গতকাল সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা রয়েছে। তাই প্রয়োজনে করোনা রোগীদের চিকিত্সার জন্য সংযুক্তির আদেশ বাতিল করে চিকিত্সকদের কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে পদায়ন করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এলে তা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। তবে দু-এক দিন বাড়লে বা কমলে পরিস্থিতি বোঝা যাবে না। কমপক্ষে টানা দুই সপ্তাহ বাড়লে বুঝতে হবে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে ৪৫০টি ভেন্টিলেটর আছে, কিন্তু জনবলের অভাবে এগুলো সরবরাহ করতে পারছি না। এগুলো চালানোর জন্য দক্ষ জনবল লাগবে। অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ছাড়া এগুলো সরবরাহ করা সম্ভব নয় এবং তাদের ছাড়া পরিচালনা করাও সম্ভব নয়।’
করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, করোনার সংক্রমণ কিছু দিন ধরে বাড়ছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নভেম্বরে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ জন আক্রান্ত হচ্ছে। সবার মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, কক্সবাজারসহ পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে, যাদের অধিকাংশই মাস্ক পরছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচার কেউ মানে না। এমনকি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও মানুষের উপচে পড়া ভিড়। স্বাস্থ্যবিধি মানে না।
এমন অবস্থার মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। তাই সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগসহ যা যা করার তা-ই করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিদেশফেরতদের করোনা সনদ নিয়ে আসতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এদিকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক বলেন, ‘বর্তমানে কক্সবাজারের হোটেলগুলোতে সাত দিন আগে সিট পাওয়া যাচ্ছে না। বিমানের ভাড়াও ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। এমন অবস্থার মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এলে আমাদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, পাড়া-মহল্লা, অলিগলিতে কেউই স্বাস্থ্যবিধি মানে না, মাস্ক পরে না। স্বাস্থ্যবিধি মানুষকে মানতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে জনসাধারণের মধ্যে বিনা মূল্যে মাস্ক সরবরাহ করা যেতে পারে। কারণ শুধু মাস্ক পরলেই নিরাপদ থাকা যাবে। তিনি বলেন, বর্তমানে যে প্রস্তুতি আছে, তাতে দিনে ৩০ হাজার মানুষকে পরীক্ষা করা যাবে। কিন্তু মানুষ পরীক্ষা করাতে আসে না। করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে ৫৫ বছরের বেশি বয়স্কদের হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
গতকাল সোমবার দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে আরো ২১ জন। এ নিয়ে দেশে সরকারি হিসাবে মারা গেল মোট ৬ হাজার ২১৫ জন। দেশে এখন পর্যন্ত করোনায় সরকারি হিসাবে মোট শনাক্ত হয়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭২ জন। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছে ১ হাজার ৬০৪ জন। মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ।