শরতের বিকেলে ফুরফুরে বাতাস বইছে। রোজি তাদের বাড়ির উঠোনে আম গাছের সাথে বাঁধা দড়ির ঝুলুমালায় বসে দোল দিচ্ছে। এই ঝুলুমালা তার খুব প্রিয়। এমনকি এই ঝুলুমালায় বসেই সে গল্পের বই পড়ে। চিড়া মুড়িও খায়। দোল দিতে দিতে সে তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। চাকুরি করবে। তার মাকে দামী লাল শাড়ী কিনে দিবে। বাবাকে সুন্দর পাঞ্জাবি কিনে দিবে। আদরের ছোট্ট ভাইটির জন্য সে অনেক কিছু কিনবে। রোজি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। সে স্বপ্ন দেখে কোন এক রাজকুমার এসে তাকে নিয়ে যাবে। একটি সুখের ঘর হবে তার। রোজি লেখাপড়াতে যেমন ভাল তেমনি দেখতে সুন্দর। মা বাবার খুব অনুগত সে। রোজি পুতুল নিয়ে খেলতে খুব পছন্দ করে। বয়স বারো পার হয়েছে মাত্র। সে পুতুলকে সাজায়। পুতুলকে চুড়ি পড়ায়, ফিতা পড়িয়ে বিয়ে দেয় আর নিজে নিজে হাসে ও মজা করে। রোজির মা শাকিলা বেগম হেসে বলে, মা রোজি তুই যেমন পুতুলকে বিয়ে দিস, তোকেও আমরা একদিন এরকম করে বিয়ে দিয়ে দেবো। রোজি তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে মা, আমি পড়ালেখা করে অনেক বড় হতে চাই। রোজির স্বপ্ন শুনে তার মা হাসে। রোজির বাবা কৃষিকাজ করে। আয় রোজগার যা হয় মোটামুটি সংসার চলে। রোজি প্রতিদিন স্কুলে যায় প্রায় দুই কিলো রাস্তা হেটে। এ সময় গ্রামের মুরুব্বিদের সাথে তার দেখা হয়। সবাইকে সে সালাম দেয়। রোজিকে সবাই আদর করে। রোজিদের গ্রামেই বাস করে জালাল মন্ডল। মাঝে মধ্যে ঘটকালি করে সে। একদিন সে রোজিদের বাড়িতে হাজির। রোজির মা তাকে পান বানিয়ে খেতে দেয়। রোজির বাবার সাথে সে রোজির বিয়ে নিয়ে কথা বলে। পাত্র পক্ষ ধনী মানুষ। টাকা পয়সার অভাব নেই। সারা বছর ঘরে খায়। সে রোজির বাবাকে বুঝায় যে তার মেয়ে রানীর মত থাকবে। পায়ের উপর পা তুলে শুধু চাকর বাকরদের হুকুম চালাবে। মহাসুখে থাকবে তার মেয়ে। মেয়ের সুখের কথা যেকোন বাবাই চিন্তা করে। রোজির বাবা মনসের আলী প্রস্তাব শুনে খুশি হয়। রোজির মা পাত্রের বয়স জানতে চাইলে ঘটল মুচকি হেসে বলে প্রতিষ্ঠিত পাত্রের বয়স একটু বেশি হয়। বড় ব্যবসায়ী। বিয়ে করার সময় হয়ে উঠেনি। চল্লিশ বিয়াল্লিশ হবে আরকি। ছেলেদের বয়সে কি আসে যায়? ছেলের টাকা আছে কিনা সেটা দেখতে হবে। রোজির বাবা চুপ করে রইলো। ঘটল বলে গেলো সে পাত্র নিয়ে পরের সপ্তায় আসবে। রোজির মা রোজিকে কিছুটা ধারণা দিলো। রোজি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। সে তার মাকে বার বার অনুরোধ করলো তাকে বিয়ে না দিতে। কিন্তু রোজির বাবা এমন ছেলে হাতছাড়া করতে চাইলেন না। যাহোক ঘটক পাত্রকে নিয়ে হাজির হল রোজিদের বাড়িতে। পাত্র দেখে রোজির চোখ ছানাবড়া। তার বাবার বয়সী পাত্র। মাথাভরা টাক। ধুমপান করতে করতে ঠোঁট দুটিকে কয়লা বানিয়ে ফেলেছে। তাতে কি আসে যায়। পাত্র ১০ কেজি রসগোল্লা হাতে করে এসেছে। রোজির বাড়ির মানুষ সহ আশেপাশের সবাই মজা করে মিষ্টি খাচ্ছে আর পাত্রের বাহবা দিচ্ছে। প্রতিবেশিরা সবাই আলোচনা করছে, মনসেরর রাজকপাল রে ভাই। এমন জামাই কজনের ভাগ্যে জুটে। মনসের প্রতিবেশিদের প্রসংশায় মুগ্ধ। এমন বড়লোক জামাইয়ের শশুর হবে সে। ভাবতেই যেন তার ভাল লাগছে। কিন্তু একবারের জন্যও তার ১২ বছরের মেয়েটির অনুভূতি জানার প্রয়োজন মনে হয়নি। রোজির মায়ের কিছুই করার নেই। মনে মনে সেও কিছুটা খুশি। তবে তার মেয়ের বয়স অনেক কম এটা তাকে ভাবাচ্ছে। প্রতিবেশিরা বুঝায় মেয়ের বয়স বেশি হলে বিয়ে দিতে পারবানা। ছোট থাকতে বিয়ে দিয়ে দাও। যাহোক বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। পাত্র রোজির জন্য অনেক কেনাকাটা করলো। অনেক লোককে দাওয়াত করলো। একশো বরযাত্রী নিয়ে সে রোজিদের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। সাথে ব্যান্ড পার্টি। গান বাজনা চলছে। সকালে অনেকটা জোর করে রোজির মা রোজিকে গোসল করিয়েছে। কিন্তু রোজির অন্তদহনকে তার মা অনুমান করতে পারেনি। রোজির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলছে। কোনমতেই নিজের মনকে বুঝাতে পারছে না। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আধ ঘণ্টার মধ্যে বরযাত্রীরা আসবে। সবাই গেটে ভীড় করছে। কলাগাছ দিয়ে সুন্দর গেট তৈরি করা হয়েছে। দূর থেকে বাজনা ভেসে আসছে। সবাই আনন্দে রাস্তার দিকে যেতে লাগলো। রোজি একা হয়ে গেলো। সে ঘর থেকে বের হয়ে তার প্রিয় ঝুলুমালার কাছে গেলো। কতবার এই ঝুলুমালায় সে দোল দিয়েছে তার হিসেব নেই। আজ হয়তো সে শেষ দোল দিবে। তীব্র কষ্ট তার হৃদয়কে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দিয়েছে। কাউকে সে বুঝাতে পারেনি। তাই নিজের উপর নিজেই প্রতিশোধ নিবে। তবুও এমন বিয়ে সে করবে না। ঝুলুমালার দড়িটি সে গলায় পেঁচালো। সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাইলো। তার বাবা মার জন্য দোয়া করলো। হঠাৎ চিৎসার শুনে রোজির মা দৌড়ে এলো। ততোকাষণে রোজির নিথর দেহ আম গাছের ডালে ঝুলছে। রোজির মার বুকফাটা আর্তনাদ মা রোজি তোর জন্য আমি কিছু করতে পারলাম না। রাতেই পুলিশ এলো। রোজির মরদেহ গাড়িতে তোলা হল। চারিদিকে শোকের মাতম শুরু হল। গভীর রাত। রোজির বাবা সেই আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।