রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সংকট, পদ-পদবীর নষ্ট কেমিস্ট্রি ও করণীয়

ড. আমিরুল ইসলাম কনক:

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন অধ্যাদেশ জারি হলে ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত সেই সুযোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার তাগিদ খুব বেশি দেখা গেছে বলে মনে হয়নি। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিশেষত উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধসহ সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, এমনকি জীবন দানের মতো সাহসী ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা। দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক ড. জোহা ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দেন তৎকালীন সরকারের বাহিনীর হাতে। স্বাধীনতার অর্ধশত বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছে সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। শিক্ষক সমাজে তৈরি হয়েছে বিভাজন। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক শিক্ষকদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব। নিন্দুকেরা বলে থাকেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরাট একটি অংশ জ্ঞানচর্চা-গবেষণার চেয়ে তোষামোদ-দলবাজিতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাদের মতে, বিভিন্ন সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উচ্চপদে নিয়োগে যোগ্যতা, পা-িত্য বা সুনামের বদলে সরকারি দলের প্রতি রাজনৈতিক আনুগত্য, স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিস্বার্থই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যে উদার চিন্তা, সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তা আজ বাধাগ্রস্ত।
বর্তমান সরকারের নিয়োগকৃত উপাচার্য প্রফেসর ড. এম আব্দুস সোবহান ২০১৭ সালের ৭মে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই পূর্ববর্তী উপাচার্য প্রফেসর ড. মিজান উদ্দিনের অনুসারী কতিপয় শিক্ষকের তোপের মুখে পড়েন। বেশ কিছুকাল যাবত তারা প্রফেসর এম আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করে মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি দিতে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় তারা বিভিন্ন অভিযোগ সম্বলিত ৩০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদেন দুর্নীতিদমন কমিশন, ইউজিসি ও শিক্ষামন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। বর্তমান উপাচার্যের বক্তব্য, তার দুই মেয়াদের দায়িত্বগ্রহণের মধ্যবর্তী মেয়াদে দায়িত্বরত উপাচার্য প্রফেসর মিজান উদ্দিনের প্রশাসনের নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতি অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করার পর থেকেই বর্তমান প্রশাসন বিরোধীরা এতটা মারমুখী আচরণ করে আসছেন। ইউজিসি অভিযোগের বিষয়গুলো আমলে নিয়ে গণশুনানীর আয়োজন করে প্রফেসর এম আব্দুস সোবহানকে উপস্থিত থাকার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। গণশুনানীর গঠনগত প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও অনুসন্ধান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে প্রফেসর আব্দুস সোবহান তা স্থগিত করে সরাসরি তদন্তের আবেদন করেন। প্রফেসর আব্দুস সোবহান বা তার কোনো প্রতিনিধি গণশুনানীতে উপস্থিত না হওয়ায় ৩০০ পৃষ্ঠার অভিযোগের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে ইউজিসি ২৫টি অভিযোগের সত্যতা রয়েছে মর্মে মূল প্রতিবেদন ৩৬ পৃষ্ঠা এবং সংযোজনী ৭০০ পৃষ্ঠাসহ মোট ৭৩৬ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রদান করেন। সেই সাথে উপাচার্য প্রফেসর আব্দুস সোবহান, উপ-উপাচার্য চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া, রেজিস্ট্রার এম এ বারীসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ ও সম্পদ অনুসন্ধানের সুপারিশ করেন। এর প্রেক্ষিতে প্রফেসর আব্দুস সোবহান গত ২৫ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহের ব্যাখ্যা দেন এবং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মত প্রকাশ করেন। ২৬ অক্টোবর থেকে উপাচার্যপন্থী শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পূর্ববর্তী মেয়াদে দায়িত্বরত উপাচার্য প্রফেসর মিজান উদ্দিনের সময়ে সংঘটিত নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিচার চেয়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদসহ লাগাতার কর্মসূচী দিয়ে আসছেন। বর্তমানে সরকারপন্থী শিক্ষকগণ দু’টি বলয়ে বিভক্ত। এই বিভক্তির মূলে দুর্নীতি ও অনিয়ম অনুসন্ধানের চেয়ে ব্যক্তি আক্রোশ ও পদ-পদবীই মুখ্য। এক পক্ষ কিছুতেই অন্য পক্ষের ক্ষমতাচর্চাকে সহ্য করতে পারছেন না। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর দলীয় রাজনীতি চর্চা প্রভূত্ব করায় পদ-সম্পদ বাঁটোয়ারার নীতি শিক্ষকদের দলীয় ও উপদলীয় রাজনীতিমুখী করে তুলেছে। ৭৩’র অধ্যাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য একটি অর্জন হলেও অধ্যাদেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। অপরদিকে দলীয় রাজনীতি মুখ্য বিবেচ্য হওয়ার কারণে সারা বছর ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক শিক্ষকদের নানা নির্বাচনে প্রার্থীতা, অপপ্রচার, ভোট কাটাকুটি, টেবিল রাজনীতি, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার, দল-উপদল গঠন ও তৈলমর্দনের মাধ্যমে প্রশাসনিক পদগ্রহণসহ শীর্ষব্যক্তিকে ঘিরে থাকাই যেন বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইউজিসির কৌশলপত্র ও বিশ্বব্যাংকের নয়া উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের নামে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার নানা তৎপরতা সম্পর্কেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অজ্ঞতা হতাশাব্যঞ্জক। হীন রাজনীতিপ্রবণ শিক্ষকদের স্বার্থপরতার লক্ষ্যে পৌঁছানোই যেন জীবনে সফলতার মানদ-। যখন যে দল ক্ষমতারোহণ করেছে, তখন সেই দলের মদদপুষ্ট ছাত্র সংগঠন হল দখল, সিট বাণিজ্য, গেস্টরুম, গণরুম বাণিজ্য করে আবাসিক হলগুলোকে আতঙ্কের কেন্দ্র করে তুলেছে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মাঝে তৈরি হয়েছে আশাতীত দূরত্ব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সঙ্কট একদিনে তৈরি হয়নি। রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্কটের নানা প্রতিক্রিয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে চিন্তার স্বাধীনতা, প্রশ্ন করার অধিকার, বিদ্যমান পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ চর্চার পরিবর্তে শিক্ষদের পদ-পদবী গ্রহণের নষ্ট কেমিস্ট্রিতে লিপ্ত থাকার কারণেইা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ৭৩’র অধ্যাদেশের অপব্যবহার রোধ ও যুগোপযোগী করে আইন-নীতি প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। স্থানীয় রাজনীতি ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে না রেখে, ক্ষতাবিভাজনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত শিক্ষকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ বন্ধ করতে হবে। সিনেট, সিন্ডিকেট, রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট, ছাত্রসংসদ ও উপাচার্য প্যানেলে সরকারের প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। যে সকল রাজনৈতিক দল পালাক্রমে বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে তাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এভাবেই সামরিক সরকার যে স্বৈরাচারী নীতি গ্রহণ করেছে, পরবর্তী সরকারগুলোও তা অনুসরণই কেবল করেননি, ক্ষেত্রবিশেষে অধিকতর নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং নাগরিক সমাজের এ বিষয়ে নীরতা নিতান্তই পীড়াদায়ক। দেশের প্রাচীনতম দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রাম জরুরি হয়ে পড়েছে।