নাসিম উদ্দীন নাসিম —সুদ বা দাদন ব্যবসা সম্পর্কে জানেনা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। ১৮ শতকে দাদন ব্যবসা কোম্পানি নিযুক্ত দালালদের মাধ্যমে পরিচালিত হলেও পরে ১৭৫৩ সালে তা রহিত করা হয়। অতীতে কোম্পানীর স্বার্থে শুরু হওয়া এই দাদন ব্যবসা ২১ শতকের বর্তমান বাংলাদেশে শুধু ব্যপক আকারই ধারন করেনি, বরং সমাজের কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে এর আগ্রাসী রুপ। দাদন প্রথা সংস্কার হয়ে বর্তমানে রুপ লাভ করেছে সুদের ব্যবসায়। পূর্বে ধনী মানুষেরা অংশ নিলেও বর্তমানে এই ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েছে মধ্যবিত্তরা। বিনা লোকসানে রাতারাতি কোটিপতি হতে অভাবি ও নিম্নবিত্ত মানুষদের চড়া সুদে টাকা দিচ্ছেন দাদন ব্যবসার নব্য কর্ণধার মর্জিনাদের মতো সুদারুরা।আলাদীনের আশ্চর্যের প্রদীপ পেয়েও ১০ বছরে কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হওয়ার বাস্তব গল্প হয়তো নেই। কিন্তু সুদের ব্যবসা করেই কোটিপতি বনে গেছেন রিকশাচালকের স্ত্রী মর্জিনা। আমাদের নাটোরের বেশির ভাগ মর্জিনাদের মতো দাদন ব্যবসায়ী সুদে টাকা দেয়ার আগে গ্রহিতার কাছ থেকে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়। শুধু তাই নয়, গরীব মানুষদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলতে বাধ্য করে তাদের কাছ থেকে ব্যাংকের ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর নিয়ে নিজের জিম্মায় নিয়ে নেয় দাদন ব্যবসায়ী খ্যাত সুদখোররা।এদিকে সুদে টাকা নিয়ে নির্ধারিত সময় সুদের টাকা দিতে ব্যর্থ হলেই গ্রহীতার উপর চালানো হয় মানষিক ও অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন। গালাগালিও করা হয় অশ্লীল ভাষায়। কোন ক্ষেত্রে দু’ এক মাস সুদের টাকা দিতে না পারলে সুদের সুদ টেনে হিসাব পাকা পোক্ত করে গ্রহিতার উপর চাপ সৃষ্টি করেন সুদারুরা। তাদের কাছে গচ্ছিত ব্যাংকের চেক ও ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর থাকায় প্রতিবাদও করতে পারেনা দরিদ্র শ্রেণীর এসব মানুষ।শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, হঠাৎ করেই সুদ গ্রহীতার কাছে সুদ ও আসলের টাকা সমূলে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে সুদারুরা। দিতে না পারলে ব্যাংক চেকে বিরাট সংখ্যক টাকার এ্যামাউন্ট বসিয়ে ব্যাংকে জমা দিয়ে ডিজওনার করা হয়। এর ফলে চেক জালিয়াতির মামলায় কারাবাস হয় সুদ গ্রহিতার।আবার অনেকেই গ্রামগঞ্জের সুদারুদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে এনজিও থেকে ঋণ তুলছেন। সেই টাকা দিয়ে সুদারুদের সুদের টাকা পরিশোধ করছেন। এর পর শুরু হয় সুদ থেকে কিস্তি দেয়া আবার কিস্তির টাকা দিয়ে সুদের টাকা পরিশোধ করার সাপ লুডু খেলা। এ খেলায় সর্বশেষে নি:স্ব ও নিরুপায় হয়ে প্রাণ হারাতে বাধ্য হয় দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র বনে যাওয়া সুদ গ্রহীতা।ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের অভিযোগ, চক্রবৃদ্ধি সুদ আর প্রতারণার মাধ্যমেই কোটি টাকা, জমি ও বাড়ি করেছেন মর্জিনা । খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নাটোর শহরের রথবাড়ী এলাকার সুদ ব্যবসায়ী গ্যাং প্রধান মর্জিনা খাতুনের বিরুদ্ধে চক্রবৃদ্ধি সুদের ব্যবসা করার অভিযোগ উঠেছে। তার কাছ থেকে সুদে টাকা নেয়ার সময় রাখা অনেক জমির কাগজ দিয়ে নানা প্রতারণাও করেন তিনি। অসংখ্য মানুষ তার সুদের ফাঁদে পড়ে হয়েছেন সর্বস্বান্ত। যখন সারাদেশে করোনা ভাইরাসে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষজন কর্মহীন হয়ে সংসার নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছিল। স্ত্রী পুত্রপরিজনের মুখে তিনবেলা আহার তুলে দিতে পারছেননা। ঠিক সে সময় মর্জিনার সুদের কারবারি গ্যাং ও তার সিন্ডিকেট সদস্যদের হুমকি ধমকি,মামলা মোকদ্দমায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে অসংখ্য শিক্ষক,কর্মচারী ও নানান পেশার মানুষজন। তারা সহজ শর্তে ঋণদানের কথা বলে ৩০০ টাকার ননজুডিশিয়াল ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর ও চেক বইয়ের প্রতিটি খালি পাতায় স্বাক্ষর ও জমির মূল দলিলপত্র গ্রহণ করে। এক লাখ টাকার কম হলে মটরসাইকেল, স্বর্ণের গহনাসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিষপত্র নাজমা তার হেফাজতে নিয়ে রাখে। ঋণ গ্রহীতাকে আশ্বস্ত করে বলে টাকা শোধ হলেই এসব জিনিষপত্র ফেরত পাবেন। কিন্তু ঋণ গ্রহীতারা আর কখনো তাদের সখের, দামী জিনিষপত্র, দলিলপত্র ফেরত পায় না। চক্রবৃদ্ধি সুদের জ্বালে একসময় তাদের ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি টাকা দিয়েও গচ্ছিত রাখা দলিল আর ফেরত পাননা। এরপর শুরু হয় চেকের পাতা দিয়ে প্রতারণা, শেষপর্যন্ত জমি হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা ঘটে।মানমর্যাদা, মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়েও মুখ খোলেননা। সুদের টাকা পরিশোধকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে প্রতিনিয়তই ঘটছে আত্মহত্যা বা খুনের মতো ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে সুদের জন্য আত্মহত্যা করা মানুষটিকে মরার পরেও ছাড় না দিয়ে পরিবারকে সুদের টাকা দিতে বাধ্য করার মতো বর্বর মানসিকতার পরিচয়ও দিয়ে চলেছেন তারা। সুদারুদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে এনজিও থেকে ঋণ তুলছেন নিরীহ মানুষ। সেই টাকা দিয়ে সুদারুদের সুদ পরিশোধ করছেন। এরপর শুরু হয় সুদ থেকে কিস্তি দেওয়া আবার কিস্তির টাকা দিয়ে সুদের টাকা পরিশোধ করার সাপলুডু খেলা। এ খেলায় সর্বশেষে নিঃস্ব হয় অনেকে। সুদ পরিশোধকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়তই ঘটছে আত্মহত্যা বা খুনের মতো ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে সুদের জন্য আত্মহত্যা করা মানুষটিকে মরার পরও ছাড় না দিয়ে পরিবারকে সুদের টাকা দিতে বাধ্য করার মতো বর্বর মানসিকতার পরিচয়ও দিয়ে চলেছে তারা। গত ১৪ সেপ্টেম্বর নাটোর শহরের ঘোড়াগাছা এলাকার সুদের কারবারী মর্জিনা বেগমের সুদের চাপ সইতে না পেরে ৬ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইমতিয়াজ আহম্মেদ বুলবুলের (৪৬) আত্মহত্যার ঘটনায় মর্জিনার ভাই সাদ্দামকে আটক করেছে পুলিশ। পরে সুদারু মর্জিনা,স্বামী হোসেন আলী,বোন হাসিনা আদালতের আত্মসমর্পন করলে আদালত হাসিনাকে জামিন দেন । বাঁকি তিনজনকে জেল হাজতে প্রেরণ করে । ঘটনার বিবরণে জানা যায়,, শহরতলীর ঘোড়াগাছা গ্রামের হোসেন আলীর স্ত্রী সুদ কারবারী মর্জিনা বেগমের কাছ থেকে সুদে ২০ হাজার টাকা নেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বুলবুল। সুদসহ প্রায় তিনলাখ টাকা পরিশোধ করেন। তারপরও দুই লাখ টাকা দাবি করে তার ওপর অত্যাচার চালিয়ে আসছিল মর্জিনার বাহিনী। শনিবার রাত ১০টার দিকে সুদ ব্যবসায়ী মর্জিনা লোকজন দিয়ে বুলবুলকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর বিবস্ত্র করে মারপিট করে দুটি চেকে দুই লাখ টাকা লিখে স্বাক্ষর নেয় ও ভিডিও করে স্বীকারোক্তি নেয়।মূলত সুদের টাকার চাপ সইতে না পেরে শহরের ঘোড়াগাছা আমহাটি এলাকার মুদি ব্যবসায়ী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ইমতিয়াজ আহম্মেদ বুলবুল রবিবার ভোরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এ সময় প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়। সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার লাশ নাটোরে এনে গাড়ীখানা গোরস্থানে দাফন করা হয়।স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ইমতিয়াজ আহম্মেদ বুলবুলের ভাগিনা সোহাগ জানান, মামা মৃত্যুর আগে ব্যক্তিগত ডায়রিতে সুদ ব্যবসায়ী মর্জিনা বেগমের অত্যাচার নির্যাতনের কথা লিখে গেছেন।কিন্তু আদালত তা গ্রহণ করেনি । আসামীদের রিমান্ড মঞ্জুর না করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন ।নাটোর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও আইনজীবী সহকারী মরহুম বদরে আলম গুলুর স্ত্রী হাজেরা বেগম সুদে টাকা নিয়েছিল মর্জিনার কাছ থেকে ।সময়মতো সুদের টাকা না দেওয়ার কারণে হাজেরাকে চুলের মুঠি ধরে রাস্তার ফেলে মারপিট করে । সুদের টাকার চাপ সইতে না পেরে তিনিও মৃত্যুর পথ বেছে নেয় ।এছাড়া প্রাণ কোম্পানীর কিউসি পদে কর্মরত রাসেল ৭০ হাজার টাকা নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করার পরও ১০ লাখ টাকার চেক জালিয়াত মিথ্যা মামলায় সাত মাস ধরে কারাগারে আটক রয়েছে ।তাঁর স্ত্রী সন্তানরা মানবেতর জীবন যাপন করছে । কোথা থেকে পাবে তারা মর্জিনার চাহিদার ১০ লাখ টাকা ? ব করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া দিনমজুর সামাদ পাঁচ মাস ধরে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে না পারায় ২৪ আগস্ট দাদন ব্যবসায়ী মর্জিনা ও সাদ্দাম তার বাড়ি থেকে দুটি গরু নিয়ে যায়। শুধু নিরীহ মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন, তা নয়। বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও গৃহস্থ মানুষ বেকায়দায় পড়ে সুদে ধার নিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। সারা মাস চাকরি করেন। মাস শেষে সুদারুর কাছে গচ্ছিত রাখা চেক দিয়ে টাকা তুলে নেয় সুদারু মর্জিনাদের হাতে ।মর্জিনার স্বামী হোসেন আলী এক সময় রিকশা চালাতো এখন সুদের বদৌলতে অঢেল ধন সম্পদের মালিক । মর্জিনার দুই ছেলে, বোন হাসিনা ,ভাই সাদ্দামের সুদের ব্যবসায় পেশা ও নেশা । শহরের রথবাড়ি এলাকার দিনমজুর ভ্যানচালক মুরগী জিপ্পুর মিয়ার পুরো পরিবার সুদ ব্যবসা ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে ।সুদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে সুদারুরা তৈরি করেছে গ্যাং। সুদারুরা সংঘবদ্ধ হয়ে চালিয়ে যাচ্ছে এ ব্যবসা। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের ভাড়াও করে দেওয়া হয় হুমকি। বিগত দিনে র্যাবের গুলিতে নিহত হ্যান্ডকাপ সাব্বির এবং তাঁর বাহিনীকে দিয়ে পৌর এলাকার তিনটা বাড়ির মানুষকে বের করে দখল করে মর্জিনা ।মর্জিনার সুদের টাকা আদায়ের জন্য স্থানীয় এক প্রভাবশালী যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে বিচারের নাম প্রহসন চলতো । হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ঐ যুবলীগের কথিত নেতার শেল্টারে চলতো মর্জিনা পরিবারের দাদন ব্যবসা ।স্থানীয়দের ধারণা মর্জিনাদের দাদন ব্যবসায় তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে । সুদ বা দাদন প্রথার ওপর সব ধর্মীয় আইনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানতে নারাজ সুদারুরা। প্রচলিত আইনেই সুদারুদের শাস্তির কোন বিধান নেই ।সুদখোরদের কর্মকাণ্ড বন্ধে তাই প্রশাসনও যেন অসহায়।চক্রবৃদ্ধি সুদে মানুষের সর্বশান্ত হওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র দায়রা জজ আ ব ম আবু সাঈদ এ প্রতিনিধিকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্থরা আদালতে মামলা করলে প্রত্যেকেই প্রতিকার পাবেন। দিনাজপুর জজ কোর্টের আইনজীবি সৈয়দুল আলম শান্তু বলেন, সুদের কারবারিকে ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা করার বিষয় না। এটি জুডিশিয়াল আদালতের বিচার্য বিষয়। সকল ক্ষতিগ্রস্থরা আদালতে বিচার প্রার্থী হলে সকলে প্রতিকার পাবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।এখন কথা হলো, সমাজে যখন সুদের জন্য মানুষ মরছে, খুন হচ্ছে, মারপিটের শিকার হচ্ছে তখন এদের দৌরাত্ম বন্ধে সু নির্দিষ্ট আইন করা সময়ের দাবিতে পরিনত হয়েছে। তা না হলে দিন দিন যদি সুদ খোরদের এমন আগ্রাসন বৃদ্ধি পেতে থাকে,তাহলে সুদ খোররা যেমন ধনী ও বেপরোয়া হয়ে উঠবে তেমনি নিম্নবিত্তরা নি:স্ব হতেই থাকবে। সেই সাথে বেড়ে যাবে অপরাধ কর্মও। তাই রাতারাতি বড় লোক হওয়ার লালসায় লিপ্ত এসব সুদ খোরদের রুখতে সরকারের কাছে দাবি একটিই “মর্জিনাদের ঠেকান,মানুষ বাচান”!!
—
With Best RegardsNasim Uddin Nasim
Natore District CorrespondentBangladesh ProtidonCellular :- 01737065605