এবাদত আলী
সম্প্রতি ফেসবুকে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে। তিনি বলেছেন,‘‘ সন্তান ১ বছর লেখাপড়া না করলে মুর্খ হবেনা, কিন্তু করোনাভাইরাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে গেলে অনেক মায়ের কোল খালি হবে।’’ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনির এহেন উক্তি নিয়ে ঢের কথা হয়েছে। তা হোক, যে যা বলে বলুক তাতে কিছু যায় আসেনা। বৈশি^ক মহামারি করোনাভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে শিক্ষার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়াটা খুব বেশি জরুরি নয় বলেই তিনি একথা বলেছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীনসহ উন্নত বিশে^ বিরূপ অভিজ্ঞতা, শিক্ষার চেয়েও জীবনের মূল্য অনেক বেশি বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বাধ্য হয়ে তারা বিকল্প পথে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখার কথা ভাবছে। কারণ যতকিছুই করা হোক ক্লাসে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দুরত্বসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবেনা। তাছাড়া একজন ক্ষিার্থী আক্রান্ত হলে তার মাধ্যমে ক্লাশের অন্য শিক্ষার্থীদের ও পরিবারের মধ্যে বাড়বে সংক্রমণ। তাই তাদের আশঙ্কার উর্ধে রাখতে হবে। করোনা সংক্রমণের শীর্ষস্থানীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন ‘আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্টিক্সে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মহামারির মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতি বলে প্রমাণ করা হয়েছে। গত জুলাই মাসে ২ সপ্তাহের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ভয়ঙ্কর পরিণতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সংগঠনটি। আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্টিক্স বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল খ্রলে দেওয়র সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ১ লাখ শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রসণ সনাক্ত হয়। ১৭ মার্চ থেকে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদান চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বেতারের মাধ্যমেও শুরু হয়েছে প্রথমিকের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠদান। আর বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনার পর দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে পাঠদান চালু রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৩অক্টোবর পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে অনেকে। জাতিসংঘের শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো করোনাভাইরাসের প্রদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৩ শিক্ষার্থী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাক প্রথমিকে ১ কোটি ১৮ লাখ ৫ হাজার ৮২৫, প্রাথমিকে ৮৭ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩, মাধ্যমিকে ৮৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৬ ও উচ্চশিক্ষায় ১২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন,আগে বাঁচতে হবে তারপর শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। না বাঁচলে ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠ গ্রহণ করবে কিভাবে? তিনি বলেন, কারিকুলাম আংশিক সম্পন্ন করে ওপরের ক্লাসে উত্তীর্ণ করে দিলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে লার্নিং গ্যাপ তৈরি হবে। ক্রমে এ গ্যাপ বাড়তে থাকবে। ’ এই শিক্ষাবিদ বলেন, করোনার প্রকোপ একটু কমে এলে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যায় তখন ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যতœসহকারে পাঠ দান করে মার্চে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে।’ সিদ্দিকুর রহমান বলেন,কারিকুলাম শেষ করার পর প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নিয়ে প্রমোশন দিলেও কোন সমস্য নেই। কিন্তু এইচএসেিত পরীক্ষা নিতেই হবে। কারণ এই পরীক্ষার সঙ্গে উচ্চ শিক্ষার নানা বিষয় জড়িত।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সুত্র জানান, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ থাকায় পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির এবারের সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করতে প্রস্তাব যাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে অটো সিলেবাস কমানোসহ আরো কিছু প্রস্তাবও থাকবে এসব প্রস্তাবে। সরকারের অনুমোদন পেলে এবার প্রথমিক ও এবতেদায়ি সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা নেওয়া হবেনা।
বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক হল গুলোয় সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবেনা। অনেক বিশ^বিদ্যালয়ে গণরুম রয়েছে। সেখানে তো কোনভাবেই স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা যাবেনা। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে কোনভাবেই কমপ্রোমাইজ করা ঠিক হবেনা। তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় গুলোর অনেকটাতেই স্বল্পসময়ে শিক্ষকদের অনলাইনে ট্রেনিং দিয়ে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত করা হয়েছে। তারা সফলভাবে অনলাইনে পাঠদান করছেন। শিক্ষার্থীর উপস্থিতি সন্তোষজনক। কিন্তু সেভাবে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোর পাঠদান চলছেনা। পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে অনলাইন ক্লাসে সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ যারা পাঠদান করবেন তাদের আগে ডিজিটাল হতে হবে। শিক্ষকদের অ্যানালগ রেখে অনলাইন পাঠদান নিশ্চিত করা যাবেনা। এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন,‘যেহেতু করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যাচ্ছেনা সেহেতু অনলাইনে পাঠদান অব্যাহত রাখতে হবে। ’’
প্রবীন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম বলেন, এ মুহুর্তে অনলাইন পাঠদানের বিকল্প নেই, তাই এটিকেই শক্তিশালী করতে হবে। আমার মনে হয় যদি ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে অংশ নিতে না পারে তাহলে ডিজিটাল বৈষম্য ঘটবে যা কোনভাবেই উচিত হবেনা এবং তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে, শিক্ষার্থীদের অধিকারের প্রশ্ন আসবে। এজন্য শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিস্ট সবাইকেই ভুমিকা পালন করতে হবে। পদ্ধতিগতভাবে আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থী যারা অনলাইনে ক্লাস করতে পারছেনা, তাদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করা। সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের ইনটারনেট সংযুক্তির সঙ্গে ল্যাপটপ দেওয়া। দ্বিতীয়ত টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে যে কার্যক্রম চলছে সেটিকেও বিস্তিৃতি করা যায়। ’’
বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিমশন সুত্র জানান,‘ করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইন কার্যক্রমে অংশগ্রহণে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ইন্টারনেট ডাটা সরবরাহ ও স্মার্টফোন সুবিধা নিশ্চিত করতে গত ২৫ জুন শিক্ষামন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছে ইউজিসি। এছাড়া বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ডিভাইস কেনায় অসচ্ছল শিক্ষার্থীর তালিকা প্রণয়নে ৪৫ বিশ^বিদ্যালয়ের উপচার্যকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে ইউজিসি। যাদের মোবাইল ডিভাইস কেনার আর্থিক সক্ষমতা নেই তাদের তালিকা ২৫ আগস্টের মধ্যে ইউজিসিতে পাঠাতে বলা হয়েছে। (সুত্র বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ আগস্ট-২০২০)। । (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১