মারণ ব্যাধি কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের অযাচিত আক্রমণে গোটা বিশ^ আজ স্তম্ভিত। অঘোষিত মরণ খেলায় এপর্যন্ত আট লাখ ৩০ হাজারেরও অধিক মানুষ তাদের অমূল্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। সামনে আরো কত জীবন দিয়ে করোনার খেসারত দিতে হবে কে জানে? আমাদের বাংলাদেশে ৪ হাজার ১৭৪ জনের বেশি মানুষ করোনার বলি হয়েছেন। প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের পরিবার পজিনসহ শোক সাগরে ভাসছে গোটা দেশ। অতি মারি করোনার ছোবলে সকলেই আজ তটস্থ। এরই মাঝে আরবী প্রথম মাস বেদনাবিধুর ও শোকাহত মহরম মাসের আগমণ। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর অতি আদরের দৌহিত্র, জান্নাতে যুবকদের সরদার হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর সাহাদাৎ বরণের দিন সমাগত। ১০ ই মর্হরম বা আশুরা তাই বাঙালি মুসলমানদের হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টিকারি একটি অধ্যায়।
কারবালা প্রান্তরের বিষাদময় ঘটনার পর হতে ১০ ই মর্হরম বা পবিত্র আশুরা পালন উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিলো এদেশে। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় সেসময় সৈয়দ মীর মুরাদ ১০৫২ হিজরি (১৬৪২ খ্রি.) ঢাকার ঐতিহাসিক হোসেনী দালান নির্মাণ করেন। এরপর থেকে হোসেনী দালান থেকে মর্হরমের তাজিয়া মিছিল বের হয়।
এদেশের গ্রামাঞ্চলে এমন এক সময় ছিলো যে, হজরত ইমাম হোসাইন(রা.) এর স্মরণে কাসেদ বের করা হতো। ছোট বেলা কোন পুত্র সন্তানের রোগ ব্যাধি হলে মায়েরা কাসেদে পাঠানোর মানসা (নিয়ত) করতেন। সন্তান সাবালেগ হলে মহররমে কাসেদ বাহিনীতে যোগ দিতো। এই বাহিনীর প্রধান কাসেদ সারা বছর খোঁজ-খবর করে কাসেদ সংগ্রহ করতেন। প্রত্যেক কাসেদের পরনে লাল হাফ প্যান্ট, গায়ে লাল গেঞ্জি আর মাথায় ও হাতে লাল রুমাল বাঁধা থাকতো। তাদের হাতে থাকতো চামর। তারা হায় হোসেন, হায় হোসেন বলে জাগ গাইতে গাইতে পথ চলতো। তারা তিন দিন তিন রাত এভাবেই এলাকার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে বেড়াতো। কাসেদদের খাওয়ানোর জন্য মানতকারিরা তাদের খাবার দিয়ে এবং থাকার জায়গা দিয়ে সাহায্য করতো। ১০ মর্হরম আশুরার দিন মহরমের মেলা বসতো উল্লেখযোগ্য স্থানে। ঢোল-কাঁশি বাজিয়ে পাড়া-মহল্লায় লাঠি খেলা হতো। এসময় রাত জেগে শহীদে কারবালা, হানেফ পালোয়ান এর পুঁথি পাঠ এবং খঞ্জুরি বাজিয়ে জারি গানের বয়াতিদের মধ্যে পাল্লা হতো। সময়ের বিবর্তনে যদিও এসব প্রথা বিলীন হবার পথে, বর্তমানে করোনাকালে তা একেবারেই নিষিদ্ধ ঘোষিত বলতে হয়। ঢাকার হুসেনী দালানে শিয়া মুসলমানদের তাজিয়া মিছিলও বিশেষ কড়াকড়ি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারীতে অনুষ্টিত হবে। সুন্নি সমপ্রদায়ের মুসলমানেরা বিশেষ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারিরা এদিন রোজা পালন করেন। নবী করিম (সা.)এর আহলে বয়াতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য এই দিনটিতে পবিত্র কোরআন খতম, ওয়াজ মাফিল, মিলাদ-মাহফিল ও দোয়া খায়ের করে থাকেন। তবে বর্তমানে করোনাকালে তা সীমিত আকারে পালিত হবে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশে এই দিনকে কেন্দ্র করে আচার অনুষ্ঠান যাই হোকনা কেন। পবিত্র আশুরার দিনটি বিশ্ব মুসলিমের মুসলমানদের নিকট ১০ ই মর্হরম বা শহীদে কারবালা দিবসটি খুবই শোকাবহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ বটে। চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ) এর ওফাতের পর আমির মুয়াবিয়া মুসলিম জাহানের খলিফা হন এবং তার মৃত্যুর পূর্বেই স্বীয় পুত্র ইয়াজিদকে খলিফা মনোনীত করেন । কিন্তু হযরত আলী ( রাঃ) এ দ্বিতীয় পুত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ ) ইয়াজিদকে খলিফা বলে স্বীকার করেন নি । কারন যে ব্যক্তি ইসলামের নীতি বহির্ভূত খলিফা পদে আসীন হয়ে পাপ কর্মে লিপ্ত সে কখনো খলিফার উপযুক্ত নয় ।
মোনাফেক ও ইহুদী চক্রের হোতা নরাধম ইয়াজিদ স্বৈরাচারি কান্ড কারখানা করতে থাকলে এরই প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন সত্যের সৈনিক হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ)। হযরত আলী (রাঃ) এ জীবদ্দশায়ই খিলাফতের রাজধানী মদীনা থেকে কুফাতে স্থানান্তর করেছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া পূর্ব থেকেই দামেস্কের গভর্নর ছিলেন । তিনি খলিফা হয়ে রাজধানী দামেস্কে স্থানান্তর করেন । এই দামেস্কের মসনদেই ইয়াজিদ আসীন হয় । কুফার জনগণ ইয়াজিদকে খলিফা হিসাবে মেনে নিতে পারলেননা। তাঁরা হযরত হোসাইন (রাঃ) কে চিঠির পর চিঠি দিয়ে কুফায় যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে থাকেন । হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) চিঠি গুলোর সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার জন্য তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিল কে কুফায় পাঠিয়ে দেন। হযরত মুসলিম বিন আকিল কুফায় গিয়ে দেখতে পান যে সত্যি সত্যিই কুফার মানুষ হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) কে চায় । তিনি তাই হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) কে কুফায় যাবার জন্য পত্র পাঠালেন ।
পত্র পেয়ে হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) পরিবার পরিজনসহ ৭০/৭২ জন সঙ্গী নিয়ে কুফায় রওনা হন । এ দিকে কুফায় অবস্থার আমুল পরিবর্তন ঘটালো ইয়াজিদ চক্র। ইয়াজিদ কর্তৃক নিয়োজিত নতুন গভর্নর ওবায়দুল্ল¬াহ বিন জেয়াদ কুফায় গিয়ে কুট কৌশল প্রয়োগ করে কুফা বাসিকে বশিভুত করে ফেলে । হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর দূত মুসলিম বিন আকিল কে বন্দি করে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হলো। হযরত ইমাম হোসাইন ( রাঃ ) কুফার সীমান্তে পৌছলে ওবায়দুল্ল¬াহ বিন জেয়াদের সৈন্যরা তাঁকে বাধা দান করে । অগত্যা তিনি কুফা থেকে ৪২ মাইল দুরে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক স্থানে তাবু স্থাপন করলেন । ইয়াজিদ বাহিনীর প্রায় ২২ হাজার সৈন্য সেই তাবুগুলো চার দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে¬া । ফোরাত নদী হতে পানি আনার পথ ও বন্ধ করা হলো।
এ হেন অবস্থা নিরসনের জন্য হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতির কাছে প্রস্তাব পাঠালেন এই বলে যে , আমাকে মদীনায় ফিরে যেতে দাও অথবা আমাকে ইয়াজিদের নিকট নিয়ে চলো । কিন্তু কোন প্রস্তাবেই দুরাচার সেনাপতি আমল দিলোনা। আশুরার আগের রাতে ইমাম হোসাইন (রাঃ) তার সাথীদের বলেছিলেন, যার ইচ্ছা সে এখান থেকে এই রাতের মধ্যে চলে যেতে পারে। তার সাথে থাকার অর্থই হচ্ছে নির্ঘাত মৃত্যু। কিন্তু ইমামের সঙ্গীরা প্রত্যেকে নানাভাবে তাদের আনুগত্যের শপথ করে ইমামকে ত্যাগ করবেননা বলে ঘোষণা করলেন।
মুসলিম ইবনে উজ্জাহ নামের ইমামের এক সাথী বলেন “ আমাকে যদি একবার হত্যা করে পুনরায় জীবিত করা হয় এবং ৭০ বার এ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়, তবু আমি আপনাকে ছেড়ে যাবনা। আমি নিজের জীবন দিয়ে আপনাকে রক্ষার চেষ্টা করবো, যাতে কেয়ামতের ময়দানে বিশ্ব নবী (সাঃ) কে বলতে পারি, নিজের অস্তিত্ব দিয়ে আমি আপনার বংশধরকে রক্ষার চেষ্টা করেছি।” ৬১ হিজরী মোতাবেক ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মুহাররম এক অসম যুদ্ধ শুরু হয় । ইয়াজিদ সৈন্যরা প্রথমে তাঁকে বশ্যতা স্বীকারের প্রস্তাব দেয় । হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) ঘৃনাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন । পানির অভাবে ইমাম পরিবারের শিশুরা মারা যেতে থাকে । একে একে ইমামের অনুরাগীগণ যুদ্ধে নিষ্ঠুর ভাবে শহীদ হন । তাবুতে তাবুতে কান্নার রোল ওঠে । সখিনার হাতের মেহেদি আঁকা কাঁচা রঙ মুছতে না মুছতেই হযরত কাসেম (রাঃ) মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন । ইমাম পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া । হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন । প্রথমে তিনি শত্রুদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন ।
তিনি বলেন, তোমরা কি পত্রের মাধ্যমে আমাকে এখানে আসতে আহবান করোনি? আমাকে সাহায্য করার ওয়াদা করোনি? অকল্যাণ হোক তোমাদের! যেই অস্ত্র দিয়ে তোমরা ও আমরা মিলে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এখন সেই অস্ত্র তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে চালাতে যাচ্ছো। মাছি যেমন উড়ে যায় তেমনি তোমরা আমার পক্ষে কৃত বায়াত থেকে সরে যাচ্ছো, পোকা-মাকড়ের ন্যায় তোমরা উড়ে যাচ্ছো এবং সকল ওয়াদা ভঙ্গ করছো। ধংস হোক উম্মতের এই তাগুতের দলের! এ সময় তিনি একটি তীরের আঘাতে মাটিতে পড়ে গেলে সীমার নামক এক পাষন্ড তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করে এবং তাঁর অসুস্থ্য পুত্র জয়নাল আবেদীনসহ মহিলাদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় ইয়াজিদের দরবারে । এ ভাবেই বনু হাশেমী গোত্রের নির্মম পরিনতি ঘটে । মুসলিম জাহানের শাসন ক্ষমতা স্বৈরাচারী ইয়াজিদের হাতে চলে যায় । হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) এর শহীদ হবার মধ্য দিয়ে সত্যের বিজয় নিশান উন্নীত হয়েছে । পবিত্র আশুরার দিনে ঘটেছে অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার ঘটনাবলি । আশুরা আত্ম ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর । ১০ মুহাররম তথা আশুরার সেই উপলব্ধি সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করে। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)। এবাদত আলী/সাংবাদিক ও কলামিস্ট /সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব /মোবাইল: ০১৭১২২৩২৪৬১তারিখ: ২৯/০৮/২০২০।