মহামারি করোনার প্রকোপে গোটা বিশ^ আজ কম্পমান। চলতি বছরের প্রথম দিকে শুরু হওয়া বৈশি^ক মহামারি করোনাভাইরাস কোন মতেই যেন বিদায় নিতে চাইছেনা। আপাতদৃষ্টে মনে হয় করোনা কোনদিনই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেনা। অন্যান্য রোগ ব্যাধির মত সেও কোন কোন দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকবে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এর বিচরণ কোন মতেই একেবারে যবনিকাপাত ঘটবে বলে মনে করা যায়না। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপুর্ণ দেশে তার অস্তিত্ব কোনদিনও বিলীন হবেনা বলেই মনে হয়।
বৈশি^ক মহামারি করোনার কবল হতে মুক্তি লাভের জন্য কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন, শাট ডাউন, শারীরিক দুরত্ব- সামজিক দুরত্ব মেনে চলা ইত্যাদি প্রক্রিয়াকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন তাতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হলেও করোনা তাদেরকে মুক্তি দেয়নি। বিশেষ করে আমাদের দেশের যুব সমাজ ক্রমেই অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
করোনাকালে একঘেয়ে জীবন যাপন যখন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিলো তখন তারা হাটি হাটি পা পা করে নেশার জগতে ঢুকে পড়ে। যেসকল ব্যক্তি আগে থেকেই নেশায় বিভোর থাকতো, করোনার সুযোগে কিছু তরুনকে তারা সঙ্গি করে নিলো। ‘‘নেই কাজ তো খৈ ভাজ’’ গ্রামীণ এই প্রচলিত কথাই যেন তাদের কাছে মূলমন্ত্র হিসেবে দেখা দিলো। উঠতি বয়সের তরুন, বেপরোয়া যুবকসহ বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তিগণ সময় কাটানোর অজুহাতে দিবা নিশি আড্ডায় মেতে থাকতো। এই আড্ডাখানা হতে অনেকেই নেশার জগতে প্রবেশ করে নিজের সর্বনাশের পথ তৈরি করে।
এ পৃথিবীতে জন্মলাভের পর সকল শিশু-সন্তানই নিষ্পাপ অবস্থায় প্রাকৃতিক নিয়মে বেড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে পারিপার্শিক অবস্থার কারণে বেড়ে ওঠা শিশুরা যখন কৈশরে এবং কৈশর থেকে যৌবনে পদার্পণ করে তখন তাদের চারপাশের পরিবেশ তাদেরকে বিপথে পা বাড়াতে সাহায্য করে থাকে। তারা মাদকের মত নেশার ছোবলে আটকে যায়। জীবন পথে চলতে গিয়ে নানাবিধ প্রতিকুলতার মুখোমুখি হয়ে অনেকের জীবনই বিষিয়ে ওঠে। আর এসবের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য বিকল্প পন্থা খুঁজতে থাকে। জীবন যুদ্ধে পরাস্থ কিংবা বাধাগ্রস্থ হয়ে অনেকেই নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে কেউ মদ্যপায়ী হয়, কেউ বা আবার ফেন্সিডিল, হেরাইন, ইয়াবা সেবনে অভ্যস্ত হয়। কেউ কেউ সেবন করে আফিম, ভাঙ, চড়স। সখের বসে বিড়ি কিংবা সিগারেট ফুঁকে কিংবা জর্দা দিয়ে পান খেয়ে অথবা দাঁতে মাজন হিসাবে গুল ব্যবহার করে অথবা নাকে নস্যি প্রবেশের অভ্যাস করে ধীরে ধীরে নেশার খাঁচায় বন্দি হয়। অনেকে আবার প্যাথিড্রিন ইনজেকশন নিয়ে নেশার চাহিদা পুরণ করে থাকে।
জীবনের হতাশা দুর করতে গিয়ে জীবনকে রোমাঞ্চকর অবস্থার মাঝ দিয়ে উপলব্ধি করতে গিয়ে তারা এ ধরণের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে নিজের অজান্তেই জীবনকে বিষময় করে তোলে। আসলে আমাদের সমাজে আমরা যাদেরকে নেশাখোর বলি তারা কেউই মাতৃগর্ভ হতে নেশাখোর হয়ে জন্মায়না। একটি মানব শিশু যখন এই সুন্দরতম ধরাধামে পদার্পন করে তখন পুত পবিত্র হয়ে জন্মলাভ করে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে সামাজিক অস্থিরতা আর্থিক দৈন্যতা এবং পারিপার্শিক অবস্থার কারণে বিভিন্ন প্রতিকুলতা পাড়ি দিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। সুন্দর জীবনের নাগাল পাবার বাসনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবার কারণে অনেকেই তাই ব্যর্থতার গ্লানি ঢাকতে গিয়ে নেশার ভুবনে পদচারনা করতে আরম্ভ করে। যে কোন নেশায় একবার আসক্ত হলে কিংবা আষ্টেপিষ্টে বাঁধা পড়লে তার বন্ধ কপাট খুলে সহসা আর বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়না।
বর্তমান করোনাকালে রাজধানী ঢাকাসহ নগর-মহানগর, জেলা -উপজেলাসমূহে আশেপাশের শহর-বন্দর ও গ্রাম এলাকায় মাদকদ্রব্য ছেয়ে গেছে। হাত বাড়ালেই অবাধে পাওয়া যায় হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল, চরস, ইয়াবা, নেশার ট্যাবলেট ও ইনজেকশন। সীমান্তের ওপার ভারত থেকে চোরাই পথে এই মাদক আসছে অহরহ। আমাদের দেশেও যৌন উত্তেজক জাতীয় নেশা উৎপদনের কারখানা রয়েছে।
একটি সুত্র জানায়, উত্তরাঞ্চল সড়ক-মহাসড়ক মাদক পাচারের নিরাপদ রুট। নির্বিঘেœ যাচ্ছে বাসে, ট্রাকে ও অন্যান্য মালামালের সঙ্গে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ বোতল ফেনসিডিল আসে; আসে হেরোইন এবং নেশা জতীয় ট্যাবলেট, ইনজেকশন। মাদক দ্রব্যের অবাধ বাণিজ্যে উত্তর জনপদের পাবনাসহ অন্যান্য জেলায় মাদকাসক্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
মাদকের নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে অনেকে খুন-খারাবির মত কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করছেনা। এইতো মাত্র ক’দিন আগে নেশার টাকার জন্য টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে মা’কে কুপিয়ে হত্যা করেছে এক মাদকাসক্ত ছেলে। গত ২৮ জুলাই মহর আলী (৩৮) নামে নেশাগ্রস্থ ছেলে তার মা সুন্দরী বেগমের (৫৮) কাছে নেশা ক্রয়ের জন্য টাকা চান। টাকা দিতে অস্বীকার করায় এক পর্যায়ে মোহর আলী ক্ষিপ্ত হয়ে তার মাকে দা দিয়ে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনা কমবেশি সব্রাই জানা যে, কেবলমাত্র নেশার কারণে ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে রাজধানীতে পুলিশের বিশেষ শাখার ( এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী সপ্না রহমানকে একাই খুন করে ঐশি নামে ইয়াবা সেবনকারি তাদের একমাত্র মেয়ে। এমন বহু ঘটনা আমাদের সমাজে ঘটেছে বা ঘটে চলেছে। এর কি কোন প্রতিকার নেই। যুবসমাজের এহেন বিপথগামিতায় শুশিল সমাজ আজ বিচলিত। অভিভাবকবৃন্দ, প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি, চিকিৎসক সম্প্রদায় ও সমাজসেবী সংগঠনগুলোর উৎকন্ঠা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।
করোনাকালে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দেশ জুড়ে করোনার লকডাউন চলেছে। পণ্যবাহী ও জরুরি সেবায় যুক্ত পরিবহন ছাড়া অন্যসব গণপরিবহন বন্ধ ছিলো। কিন্তু লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে, ত্রাণবাহী ট্রাক, কুরিয়ার সেবা আর নিত্যপণ্যের গাড়িতে মাদকের ছোট-বড় চালান ধরা পড়েছে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির হাতে। সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী র্যাব ঢাকাসহ সারাদেশে দেড় হাজারের বেশি মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে। রাজধানীতে ডিএমপির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ২ হাজার ব্যক্তি। বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে প্রায় ১ হাজর ২০০ টি।
নেশা জাতীয় দ্রব্য পাচারের সাথে রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ জড়িত বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর অভিমত। লকডাউনের সময় র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধে বা ক্রসফায়ারে অর্ধডজন নেশা চোরাচালানী নিহত হয়েছেন বলে জানা যায়। তাদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে ইয়াবা, ফেনসিডিল এবং অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলেছে র্যাব।
মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসা নির্মূলের জন্য পুলিশ সদস্যরা একের পর এক অভিযান চালালেও পুলিশের কোন কোন সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক সেবনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার তথ্য পাওয়া যায় খোদ পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকেই। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দি বাংলাদেশ টু ডে’র খবর অনুসারে ৪০০ এর বেশি পুলিশ সদস্যকে মাদক সম্পৃক্ততার কারণে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
গত ১৬ আগস্ট -২০২০ ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ অডিটরিয়ামে আয়োজিত ডিএমপির মাসিক অপরাধ সভায় বলেছেন, ‘মাদক সেবি সন্দেহভাজন পুলিশ সদস্য ডোপটেস্টে পজিটিভ হলে তাকে চাকরি হারাতে হবে।’
সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেছেন,‘‘ আইজিপি থাকা কালে বহু চেষ্টা করেও তিনি মাদক বন্ধ করতে পারেননি। পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পয়সাকড়ি নেয়। তাঁর মতে পুলিশের সমপৃক্ততা না থাকলে অর্ধেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। ’’ (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।