একটি মানব শিশু মাতৃগর্ভ হতে এই পৃত্থিভুমিতে আগমণের সময়কাল হতে জাগতিক নিয়মে তার শারীরিক পরিবর্তন সাধিত হতে আরম্ভ করে। শিশু,কিশোর, যুবক,বৃদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরে তার বয়সের তারতম্যে মানসিকতার উৎকর্ষ সাধিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে সব চেয়ে প্রাণ শক্তি আর সৃষ্টির উন্মাদনায় তারুন্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ তারুণ্য মানেই বাঁধ না মানা শৃঙ্খল ভাঙার প্রত্যয়। এই তারুণ্যকে হয়তো বা কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নবীন বলে সম্বোধন করেছেন। ঘুণে ধরা সমাজের পচে যাওয়া ব্যবস্থার উত্পাটনই নবীন বা তারুণ্যের মন্ত্র। বদ্ধ ঘরের দরজা ভেঙে জীবনের জয়গান গাওয়াই তাদের কর্ম।
তাই বিশ^ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩২১ সনের ১৫ বৈশাখ নবীনদেরকে নিয়ে উদ্দীপণামূলক কবিতা রচনা করেিেছলেন যা বলাকা কাব্য গ্রন্থে সংযোজিত রয়েছে। সেসময় তিনি লিখেছিলেন,‘‘ ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, / ওরে সবুজ, ওরে ওবুঝ,/ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’’ কিন্তু বৈশি^ক এই করোনাকালের জীবনধারায় তাদের নিজেদের জীবনই বাঁচা-মরার দোলনায় দোদুল্যমান। করোনাভাইরাস এমনি একটা মারণব্যাধি যে তার আক্রমণের সিংহভাগই হলো নবীন বা তরুণদের প্রতি। তাই প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশে^র প্রায় অর্ধেক তরুণই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। এছাড়া বিশে^র এক তৃতীয়াংশ তরুণ এই ভাইরাসের প্রভাবে ভবিষ্যত ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কিত।
সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। ‘ইয়ুথ এন্ড কোভিড-১৯ ইমপ্যাক্টস অন জবস, এডুকেশন, রাইটস এন্ড মেন্টাল ওয়েল বিং’ নামক জরিপটি চালায় জাতিসংঘের সংগঠন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। জরিপে বলা হয় যদি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তরুণরা করোনা মহামারির প্রভাবে দীর্ঘকাল ধরে ভুগবেন। ১১২ টি দেশের ১২ হাজারেরও বেশি তরুণ এই জরিপে অংশ নেন। জরিপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ তরুণই ছিলেন শিক্ষিত। তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে জরিপে অংশ নেন। জরিপের বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মহাপরিচালক গায় রাইডার বলেন, ‘ করোনা মহামারি তরুণদের ওপর একাধিক ধাক্কা দিয়েছে। এটা যে কাজ এবং কাজের সম্ভাবনা ধব্ংস করছে তা নয়। এটি শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একটি মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। (ইত্তেফাক, ১২ আগষ্ট-২০২০)।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে বর্তমানে যুব সম্প্রদায়ই করোনাভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করছে। অর্থাৎ যাদের বয়স ২০, ৩০ ও ৪০ বছরের কোটায় এবং যারা অসচেতন তাদের মধ্যেই মহামারি ভাইরাসটি দ্রুত ছড়াচ্ছে। বিশ^ স¦াস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও এর মতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন উপসর্গ দেখা যায়না বা থাকলেও তা মৃদু বলেও সতর্ক করেছে সংস্থাটি। গত ১৮ আগস্ট-২০২০, এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক তাকেশি কাসাই বলেন,‘ এই মহামারি তার ধরণ বদলাচ্ছে। যাদের বয়স ২০, ৩০ ,৪০ এর কোটায় তাদের অনেকেই সজাগ নয় যে তারা আক্রান্ত এমনকি তাদের মধ্যে থাকা সংক্রামক জীবাণু অনেকের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে তাও তারা খেয়াল রাখেনা। তিনি বলেন, এই প্রবণতা করোনা মহামারিতে অধিক ঝুঁকি তৈরি করেছে। এতে যারা বয়স্ক, যারা দীর্ঘদিন ধরে কোন রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন কিংবা যারা অধিক ঘনবসতি এলাকায় বসবাস করেন তাদের জন্য এই তথ্য বেশি আশঙ্কার।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহা পরিচালক (প্রশাসন) ডা. নাসিমা সুলতানা এমন তথ্য পরিবেশন করেছেন অনেক আগেই। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে এ তথ্য জানিয়েছিলেন। তার ভাষ্য মতে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তারপারই আক্রান্তের দিক থেকে এগিয়ে নয়েছেন ৩১ তেকে ৪০ বছর বয়সীরা। এই বয়সী মানুষদের অনেক বেশি সতর্কতা ও সচেতনতা প্রয়োজন। এই বয়সের মানুষেরা কর্মস্থলে বেশি থাকেন। বাইরে বেশি ঘোরাঘুরি করেন। সেটা কাজের জন্যই হোক আর অন্য কারণেই হোক। যে হেতু তরুণ বয়স তাই তারা অনেক সময় সতর্কতা ও সচেতনতাকে ঠিকভাবে গ্রহণ করেননা। এজন্য ২১ থেকে ৩০ এবং ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের বিশেষভাবে অনুরোধ করবো আপনারা সতর্ক হোন। সচেতন থাকেন। আপনার কারণে যেন আপনার পরিবারের অন্য কেউ ঝুঁকিতে না পড়ে। করোনায় মৃতদের বয়সের হার তুলে ধরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন,১ থেকে ১০ বছর বয়সীদের মৃত্যুর হার শুন্য দশমিক ৮২ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ । এর চেয়ে বেশি বয়সীদের মৃত্যুহারও কম নয়। তাই সকলকেই তিনি সাবধানতা অবলম্বন করতে অনুরোধ করেছেন। ’
রোগ তত্ববিদ ও রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের বড় অংশই তরুণ। মোট আক্রন্তের অর্ধেকই ২১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে না চাওয়া ও বাইরে বের হওয়ার কারণেই বেশি সংক্রমিত হচ্ছেন তরুণ ও যুবকরা। একই সঙ্গে ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন পরিবারের অন্য সদস্যদের। প্রশ্ন ওঠছে তরুণদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকার কথা থাকলেও তারাই কেন আক্রান্তের শীর্ষে? বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউন আর স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীনতাই অন্যতম কারণ। এছাড়া আক্রান্তদের একটি অংশ শ্রমিক, রয়েছেন শিক্ষার্থীও- এমন ধারণা দিলেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর। তিনি বলেন, ঢাকা, গাজীপুর বা নারায়নগঞ্জে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে। কারণ ওখানে বড় একটা অংশ জুড়ে শ্রমিকরা আছেন। শিক্ষার্থীরাও করোনা আক্রান্তের তালিকায় আছেন। তরুণদের আক্রান্তের হার বেশি হওয়ার কারণ তারা বেশি বেশি পরীক্ষা করাচ্ছে বলে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের সহকারি পরিচালক আয়েশা আক্তারের মতে লকডাউন না মানায় তরুণদের আক্রান্তের হার তুলনামূলক বেশি। তার আশঙ্কা তরুণরা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের।
এই আলোচনায় বিশ^ কবির নবীনদের নিয়ে আলোচনায় কেবলই হতাশার সুর। তবে করোনাভাইরাস এদেশের যুব সমাজ তথা নবীনদেরকে কোনমতেই কাবু করতে পারবেনা। কারণ তাদের অদম্য সাহস রয়েছে বুকে। তাই কবি গুরুর সেই কবিতাই আবার আওড়াতে হয়, যেমন,‘ রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে/ আজকে যে যা বলে বলুক তোরে/ সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ করে/ পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।’’ (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১ ঊসধরষ: বনধফধঃধষর ১৯৭১ @ মসধরষ .পড়স তারিখ: ২১ /০৮/২০২০.