সুপ্রাচিনকাল থেকেই প্রকুতির লীলাভূমি বাংলার গ্রামীন জীবন। প্রাণ বৈচিত্র্য এখানে মানুষের ভেদাভেদকে ভুলিয়ে দিয়েছে। সবুজের বুকে বিচরণকারি মানুষ চিরসবুজ হয়েই প্রকৃতিতে অবদান রাখছে। ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে গ্রামীন সমাজ ব্যবস্থা। ফলে পরিবর্তিত হচ্ছে আবহমান গ্রামবাংলার রুপ বৈচিত্র্য। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীন মানুষের জীবনযাপন এবং এর সাথে সম্পৃক্ত সকল ঐতিহ্যপূর্ন বিষয়। বরেন্দ্র জনপদে চিরসবুজ অপার সৌন্দর্যের গ্রাম ছোটমহারন্দী। আম, তাল, খেঁজুর, বড় বড় বটগাছ আর নতুন নতুন ফল বাগানে নবরুপে সেজেছে গ্রামটি। নতুন নতুন ফল-ফসলে পাল্টে গেছে মানুষের জীবনধারা। করোনা ক্রান্তিকালে অর্থনৈতিক ক্ষতি হলেও কর্মসংস্থানের অপার সুযোগ গ্রামকে স্বনির্ভর করে তুলেছে। মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্ঠা, দায়িত্ব গ্রহণ এবং সমন্বয় গ্রামের সার্বিক পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন করেছে। নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলাধীন দিবর ইউনিয়নের গ্রাম ছোটমহারন্দী। করোনা ভাইরাসের সংক্রমন দেখা দিলে গ্রাম উন্নয়ন দল নিজেরা মিটিং করে করণীয় নির্ধারণ করে। প্রথমে তারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বরত আব্দুল আলিমকে তাদের গ্রামে আমন্ত্রণ জানাই। নিজেদের পরিকল্পনা শেয়ার করে। সম্ভাব্য করোনা সংক্রমণ রোধে ১৩ সদস্যের করোনা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে।ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, গ্রামের প্রবীন অধ্যক্ষ ময়েজ উদ্দিন এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত আব্দুল আলিমকে কমিটির উপদেষ্টা করেন।করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা বিষয়ে নিজেরা স্বচ্ছ ধারণা নেন। গ্রামের মানুষকে চরম ছোয়াঁচে রোগের বিষয়ে সচেতন করে তোলেন। মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে সকল মানুষের সম্পৃক্ততা উপলদ্ধি করেন। একাধিক সভায় গ্রামের নারী-পুরুষ, তরুণ সকলকে সচেতন করে।গ্রামের প্রায় ৪শত পরিবারের ২৮০টি গরিব।মানুষের আর্থিক সংগতি বিবেচনায় স্বচ্ছল পরিবারের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ৩১০টি পরিবারে সাবান এবং মাস্ক বিতরণ করে।স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার গুরুত্ব অনুধাবন করতে ২০০টি লিফলেট, গ্রামের প্রবেশ পথগুলো ৫টিতে বেসিন স্থাপন করে। জীবাণু ভীতি দুর করতে পুরো গ্রাম ৪ দফায় ব্লিচিং পাউডার স্প্রে করে।
মানুষ যাতে গুজব এবং অপপ্রচারে কান না দেয় সেজন্য মসজিদে ইমামকে দিয়ে সচেতনতামূলক বক্তব্য দেয়ান।শিক্ষক এবং তরুণদেরে উদ্যোগে সীমিত সভা করেন। এসময়ে বাল্যবিয়ের প্রবণতা লক্ষ্য করে ইয়ূথ লিডার নুসরাত সিদ্দিকার নেতৃত্বে ১৬টি সভা করে। কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে ৭৫জন কিশোরীকে ২৩০ প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রদান করেছেন। কিশোরদের বিপথগামিতা প্রতিরোধে ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতায় গ্রামে ৩টি ক্যারাম বোর্ড স্থাপন করে খেলার ব্যবস্থা করেন। গ্রামের ১৩জন মানুষ কর্ম-সংস্থানের সুবাদে বাইরে অবস্থান করছিলেন, তারা বাড়িতে ফিরে আসলে তাদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছেন। কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষদের খাদ্য বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন।
গ্রামে অসুস্থ্য ৮জন মানুষের করোনা পরীক্ষা নিশ্চিত করেছেন। শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার ব্যাপারে নারী নেত্রী বুলবুলি ও নুসরাত সিদ্দিকার নেতৃত্বে ৬টি পাড়ায় তরুণরা ৫৪জন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছে।
গ্রামে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত বিষয় গ্রাম উন্নয়ন দল মিমাংসার উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছেন। টাটকা শাক-সবজি উৎপাদনের গুরুত্ব অনুধাবন করে ২৮টি পরিবারের মাঝে বীজ বিতরণ করেন এবং ১৩০টি পরিবারকে শাক-সবজি বিতরণ করেছেন। খাদ্য সংকটে পড়া ৬৫টি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের সাথে সমন্বয় করে ৯৬টি পরিবারকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সহায়তা নিশ্চিত করেছেন।
নারী নেত্রী ফাহিমা বেগম বলেন ”নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধকরণের জন্য বিভিন্নভাবে কমিউনিটি ক্লিনিকে উঠান বৈঠক করে আসছি। এখনো তা চলমান। গ্রামে কোন নারী নির্যাতনে শিকার হয়নি, কোন বাল্যবিবাহ হয়নি। আমরা অনেক ভালো আছি।” গ্রাম উন্নয়ন দলের সভাপতি মোখলেছুর রহমান বলেন ”সারা বিশ্বে মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে আমরা চেয়ারম্যানসহ গ্রামের মানুষকে নিয়ে মিটিং করি। করোনা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করি। গ্রামের সকল মানুষকে যুক্ত করি। মানুষের সাথে কাজ করতে গিয়ে কিছু ভুল বুঝাবুঝি হলেও আমরা তা সমাধান করি। এখন পর্যন্ত আমরা সবাই নিরাপদেই আছি।” ছোটমহারন্দী গ্রাম উন্নয়ন দলের উদ্যোগে করোনা সংক্রমন প্রতিরোধের সাথে সাথে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের কতগুলো লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়েছে। মানুষের ক্ষুধামুক্তি, সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ, মানসম্মত শিক্ষা, টেকসই পরিবেশ, শান্তি ও ন্যায়বিচারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং জনগন সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিলে সকল সমস্যার টেকসই সমাধান সময়ের ব্যাপার মাত্র। এক্ষেত্রে ছোটমহারন্দী হতে পারে তার দৃষ্টান্ত।