করোনা কালের জীবন ধারা-৫০

বাঙালি অকুতোভয় বীরের জাতি। তাদের বীরত্বগাথা যে সকল কর্মকান্ড রয়েছে যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল । সমগ্র বিশে^ প্রায় ১ শ ৩০ টির মত দেশ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। কোন কোন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থায়িত্বকাল অনেক দীর্ঘায়িত ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ মাত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের কাঙ্খিত লক্ষ স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। যা বিশে^র ইতিহাসে অনন্য নজির বটে।
বাঙালির সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুরন্ত ও সাহসি বাঙালি জাতিকে এক কাতারে শামিল করিয়ে বজ্র কন্ঠের হুঙ্কার ছাড়েন। তিনি হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে ব্যারাকে ফিরে যাবার আহবান জানান। পাশাপাশি তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বলেন,‘‘বাংলার মানুষ মুক্তি চায় । বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। …. আর যদি একটি গুলি চলে, যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয় তাহলে তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তা-ঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। …. মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’’
বর্তমানে ২০২০ সালের শুরু থেকেই বৈশি^ক মহামারি অতিমারি করোনাভাইরাস বিশে^র ১৮৮ টি দেশ ও অঞ্চলের মত বাংলাদেশেও আঘাত হানে। আর সেই মহামারির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষকে বঙ্গবন্ধু কন্যা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেক ঘরে ঘরে প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তোলার আহবান জানান। সেসময় বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের পাচাটা এদেশীয় দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশবাসি সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। কিন্তু এই সময়ে অদৃশ্য শত্রু করোনাভাইরাস যা বেপরোয়াভাবে মানুষের জীবন হরণ করে চলেছে, তার মোকাবিলার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে প্রথম ধাপেই সকলকে বিনা প্রয়োজনে বাসা-বাড়ি থেকে বের না হওয়া, বারবার সাবান পানি দিয়ে দুহাত অন্তত ২০ মিনিট সময় ধরে ধৌত করা। হ্যান্ড সেনিটাইজার ব্যবহার করা, লকডাউন, ক্লোজ ডাউন, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন এবং প্রয়োজনে ঘরের বাইরে গেলে মুখে মাস্ক পরাসহ সকল প্রকার স্বাস্থ্য বিধিবিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। কিন্তু অতিমাত্রায় সাহসী হবার কারণে তার সে আদেশ অনেকাংশেই উপেক্ষিত হয়। ফলে বৈশি^ক মহামারি করোনাভাইরাস অতিদ্রুত সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের পপ সঙ্গীত স¤্রাট আজম খানের সেই গানের মত যেন অবস্থা: তিনি গেয়েছেন, আলাল ও দুলাল, আলাল ও দুলাল/ আলাল যদি ডাইনে যায় দুলাল যায় বায়ে।। …… আলাল যদি ডালে থাকে , দুলাল থাকে চালে…..। অথাৎ বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ তথা সরকার তরফ হতে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার জন্য যেসকল দিক নির্দেশনা জারি করা হয় তার উল্টোটা তারা করে বসে। বীর বাঙালি করোনাভাইরাসকে থোড়াই কেয়ার করছে। ফলে যা হবার তাই হতে চলেছে। গত মার্চ মাসের ৮ তারিখে করোনাভাইরাস সর্বপ্রথম বাংলাদেশে আগমণ করে এবং ১৮ মার্চ তারিখে মৃত্যুকান্ড ঘটানো শুরু করে। যা আজ ২৫ জুলাই-২০২০ পর্যন্ত ২ হাজার ৮ শ ৭৪ জনে পৌঁছেছে। এখানেই ক্ষ্যান্ত নয়। বাংলাদেশে করোনা যেভাবে জেঁকে বসেছে এবং বসছে তাতে অতি সহজে সে বিদায় নেবে তা ভাবা কোনমতেই সমীচিন নয়। রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ফার্ষ্ট ওয়েভ বা প্রথম ঢেউ চলছে। দ্বিতীয়টি এখনো আসেনি।
করোনাভাইরাসের আক্রমণের শুরুতেই অষ্ট্রেলিয়ার একটি বিশ^বিদ্যালয়ের একদল গবেষক এমন দাবি করেছিলেন যে, বৈশি^ক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে সারাবিশে^ প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্রাণ হারাবে। অষ্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষকদল আরো বলেছিলেন, সংক্রমণ যদি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে পৌঁছে তাহলে বিশ^ জুড়ে করোনাভাইরাসে প্রাণহানির সংখ্য ৬ কোটি ৮০ লাখে গিয়ে ঠেকতে পারে। (তথ্যসুত্র: দৈনিক সিনসা-৭ মার্চ-২০২০)।
বিশ^ বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, ‘ বিশে^ এমন এক নতুন কিছু আসতে চলেছে যা পৃথিবী ধব্ংসের কারণ হতে পারে। সময় যত এগোবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ততই উন্নত হবে। ফলে পারমাণবিক যুদ্ধ, বিশ^ উষ্ণনায়ন ও জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ারডর্ ভাইরাস বাড়বে। আর তার ফলে ধ্ব্ংস হতে পারে পৃথিবী। অর্থাৎ করোনাভাইরাস মানুষেরই কোন গবেষণার ফল হতে পারে। সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। ইতোমধ্যে কিছু প্রমাণও আসছে যে, চীনের উহানের সেই ল্যাব থেকেই করোনাভাইরাসের যাত্রা। যেখানে বিপজ্জনক সব ভাইরাস নিয়ে গবেষণা হতো। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, করোনা দীর্ঘ মেয়াদি হতে পারে। অর্থাৎ হাজার হাজার মৃত্যু এখন আমাদের প্রতিদিনের পরিচিতি সংখ্যা হয়ে উঠবে। এ থেকে বাঁচার বড় উপায় মানুষের চিন্তা-চেতনা ও কর্মের পরিবর্তন।(কালের কন্ঠ,১৮ এপ্রিল-২০২০)।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কি তা অনুভব করছে? বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় উল্লেখ করেছিলেন, আমি তাই করি ভাই, যখন চাহে এমন যা/ করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। ….. আমি শাসন-ত্রাসন সংহার আমি উষ্ণ চির অধীর/ বল বীর……..।
আগেই বলা হয়েছে বাঙালি বীরের জাতি। তাই তাদের ভয়-ডর একটুখানি কম। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের (এসইউটিডি) ডেটা ড্রাইভেন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকরা বলেছিলেন,‘ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আগামি মে মাসের মধ্যে শেষ হচ্ছে। বাংলাদেশে এ ভাইরাসটি ১ লা মে র মধ্যে ৯৭ শতাংশ, ৩০ শে মের মধ্যে ৯৯ শতাংশ বিলীন হয়ে যাবে। তবে তারা একথাও বলেছিলন যে, ভাইরাসটি বিস্তারের ধরণ, মানব দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য, সব মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভাইরাসটির পুরোপুরি বিদায় নিতে ১৫ জুলাই পর্যন্ত সময় গড়াতে পারে। তবে শুধু মুখের ভবিষ্যৎ বাণী দ্বারা কাজ হবেনা। ভাইরাসের প্রকোপ কমাতে পারে একমাত্র প্রতিষেধক।
এধরণের একটি আশার খবর প্রচারিত হয় গত ৪ জুলাই জি ২৪ ঘন্টায়। তাতে বলা হয়েছে ওপার বাংলার গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড দাবি করেছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারে তারা অনেকটাই এগিয়েছেন। পশুর শরীরে পরীক্ষা করে আশানুরূপ ফল পেয়েছেন তারা। সংস্থার রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রধান ডা. আসিফ মাহমুদ ভ্যাকসিন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ভ্যাকসিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেন। তার সঙ্গে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ।
অপরদিকে ভারত সরকারের অনুমতিপ্রাপ্ত একটি বেসরকারি ল্যাব থাইকেয়ারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আরোকিয়াস্বামী ভেলুমানি নিজের ট্যুইটার হ্যান্ডেলে জানিয়েছেন যে, ভারতে ইতোমধ্যেই অন্তত ১৮ কোটি মানুষের দেহে করোনার অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গিয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং ইমিউনিটি ভালো থাকায় কোন উপসর্গ টের পাওয়া যায়নি। কোন রকম চিকিৎসা ছাড়াই এরা নিজে নিজে সুস্থ্য হয়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশের বীর বাঙালিদের জন্য এমনটি হয়নিতো? (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।