সরকারের মেগা প্রকল্প রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ করোনা মহামারীর মধ্যেও পূর্ণদ্যমে এগিয়ে চলেছে। সরকারের লক্ষাধিক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সর্ববৃহৎ এই প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে ৩০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে নিয়ে প্রকল্পের কাজে জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমানে দেশী ও বিদেশী প্রায় দশ হাজার মানুষ প্রকল্পে কাজ করছে বলে প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর জানিযেছেন।
গত ১১ই জুলাই শনিবার প্রকল্পের কাজের সর্বশেষ অবস্থা পরিদর্শনেড. শৌকত আকবর ঈশ্বরদীর রূপপুরে এলে ইত্তেফাককে জানান, সিডিউল অনুযায়ী কাজ এগিয়ে চলেছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কাজের গতি পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। দু’টি ইউনিটের রিঅ্যাক্টর ভবন নির্মাণ কাজে যথেষ্ঠ অগ্রগতি হয়েছে। নির্মাণ কাজ ৩০ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ঈশ্বরদীর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের নিমিত্তে ১ম ইউনিটের মূল স্থাপনার কংক্রিট ঢালাই কাজ উদ্বোধন করেন । পরের বছরই দ্বিতীয় ইউনিটের চুল্লির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। রাশিয়ান ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের নির্মাণ কাজ শুরুর ৬৮ মাসের মধ্যে মূল স্থাপনা নির্মাণ সম্পন্নের কথা রয়েছে। ড. শৌকত জানান, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম ইউনিটের এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট হতে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়া সম্ভব হবে।
বর্তমানে দুই হাজার বিদেশীসহ প্রায় দশ হাজার জনবল এই প্রকল্পে পূর্ণোদ্যমে মহাকর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিদেশীদর মধ্যে সিংহভাগই রাশিয়ান। রুশ আর্থিক সহায়তায় ১,০৭৯ একর এবং রেলওয়ের প্রায় ৭৫ একর জমির উপর নির্মিত প্রকল্পের দু’টি ইউনিটের ব্যয় ধরা হয়েছে ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১,০১,২০০ কোটি টাকা।
করোনা পরিস্থিতিতে প্রকল্পের সার্বিক কর্মকান্ডের বর্ণনা দিয়ে ড. শৌকত আকবর জানান, করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকলে ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। লকডাউন শুরুর পর হতে এযাবত ৭৮ জন রাশিয়ান দেশে ফেরত গেছেন। অপরদিকে ৩টি চার্টার্ড বিমানে ৫৭০ জন এসেছেন। ১১ জন জার্মানও এসে যোগ দিয়েছেন। ভারতীয় ৮১ জনকে আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জুলাই ও আগষ্টের মধ্যে প্রায় ৭৫০ জন রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ এসে পৌঁছাবেন।
প্রকল্প এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি প্রসংগে তিনি বলেন, কাজে যোগ দেওয়ার আগে প্রতিদিনই তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। তাপমাত্রা বেশি থাকলে ৭ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হচ্ছে। এরপর আবারো পরীক্ষা করে সুস্থ মনে হলে কাজে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া কাজ করার সময়ও তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। রাশিয়ান ও প্রকল্পের মেডিকেল টিম এই কাজে সবসময় নিয়োজিত রয়েছে।
কোয়ারেন্টিনের জন্য আলাদা আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। বিদেশ হতে আগতদের নমুনা পরীক্ষার ‘নেগেটিভ’ রিপোর্ট সাথে আনতে হচ্ছে। তদুপরি আসার পর ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। কঠোরভাবে এসব ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে নির্মাণ কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।
পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্বলিত থার্ড প্রজন্মের প্রযুক্তি ব্যবহার করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। এরইমধ্যে প্রথম রিঅ্যাক্টর বিল্ডিংয়ের কনটেইনমেন্ট ওয়াল দৃশ্যমান হযেছে। প্রথম রিঅ্যাক্টর বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম ইউনিটের মূল যন্ত্র রিয়্যাক্টর প্রেসার ভ্যাসেল স্থাপন করা হবে বলে জানালেন প্রকল্প পরিচালক। ইন্সটলেশন করা যাবে না তবে দ্বিতীয় ইউনিটও এই বছরই নির্মাণ করা হবে । প্রথম রিঅ্যাক্টর ইউনিটের সকল যন্ত্রপাতি এ বছরই চলে আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী বছর দ্বিতীয় ইউনিটের কংক্রিট বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ এবং ইন্সটলেশন শেষ হবে।
জানা যায়, প্রথম ইউনিটের জন্য নির্মানাধীন রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেলের ‘কোর ব্যারেল’ প্রস্তুত কাজ রাশিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে। রাশিয়ার ভলগাদন্সকে অবস্থিত এইএম টেকনোলজির কারখানায় ‘কোর ব্যারেল’ নির্মাণ হয়। রুশ রাস্ট্রীয় পরমানু শক্তি কর্পোরেশন রসাটমের মেশিন প্রস্তুতকারী শাখা এটমএনার্গোমাস-এর একটি অংশ হচ্ছে এইএম টেকনোলজি। ড. শৌকত আকবর জনান, রাশিয়ার বিভিন্ন কারখানায় প্রকল্পের যন্ত্রপাতি তৈরী হচ্ছে। যন্ত্রপাতি নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও প্রকল্পে কর্মরত বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। এছাড়াও রাশিয়ার মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে একটি নিউক্লিয়ার সেকশন রয়েছে। রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানের নেতৃত্বে নিয়মিত কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে ।
হার্ডিঞ্জ সেতুর অদূরে পদ্মা নদীর তীরে ১৯৬১ সালে গৃহীত এই প্রকল্প প্রায় ৫০ বছর পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহন করেন। ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর রুশ রাষ্ট্রিয় পারমাণবিক সংস্থা রসাটমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এ্যটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সাথে বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি সম্পাদন করেন।
দেশের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্পে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মীদের আবাসনের জন্য গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে নির্মিত হচ্ছে আধুনিক মানের গ্রিন সিটি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মূখ্য সচিব নিয়মিত তদারকি করছেন বলে জানা গেছে।
করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত কয়েকটি প্রকল্পের কাজে স্থবিরতা দেখা গেলেও মেগা প্রকল্প রূপপুরের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। কোন কোন কাজ নির্ধরিত সময়ের আগেই শেষ হচ্ছে। আশা করা যায়, টাইম লাইন অনুযায়ী ২০২৩ ও ২০২৪ সালে এই প্রকল্প হতে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে। ফলে সরকারের উন্নয়ন কাজ অনেকটাই সফলতার মূখ দেখার সাথে সাথে এই প্রকল্পকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন ঘটবে।