দুই যুগে হরিয়ে গেছে যশোরসহ সারাদেশে ১২ শতাধিক সিনেমা হল

ইয়ানূর রহমান : যশোরের ঐতিহ্যবাহি সিনেমা হলের মধ্যে নিরালা, মানসী, চিত্রা, তসবীর ও মণিহার। এর মধ্যে ২১ টি সিনেমা হল থেকে কমতে কমতে এখন মাত্র ২টি চালু আছে। খুলনায় সিনেমা হল ছিল ১১টি। এখন আছে তিনটি।

রাজশাহী জেলায় সিনেমা হল ছিল ৫৫টি সেখান থেকে কমে চালু আছে মাত্র চারটি
সিনেমা হল। আর শহরে কোন সিনেমা হল নেই। এছাড়া ঢাকার মধ্যে মুন, স্টার, আরমানিটোলার শাবিস্তান, এলিফ্যান্ট রোডের মল্লিকা, বাসাবোর অতিথি, আগমন, ইসলামপুরের লায়ন, চকবাজারের তাজমহল, পোস্তগোলার মেঘনা, যমুনা, ডায়না, নারায়ণগঞ্জের মিনতি, কাওরান বাজারের পূর্ণিমার মতো হলগুলোও হারিয়ে গেছে।

যশোর সিনেমা হলের জন্য একসময় ব্যপক পরিচিতি ছিল। বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী নায়িকা সুচন্দা, ববিতা ও চম্পার জন্মস্থান যশোর, জনপ্রিয় নয়িকা সাবানার শশুর বাড়িও যশোরে। চলচ্চিত্রের প্রথিতযশা সংগীত পরিচালক মনিরুজ্জামান, রফিকুজ্জামান ও প্রয়াত প্রণব ঘোষের জন্মস্থান যশোর। সিনেমার জগতে নাড়া দিয়ে মানুষের মুক্তির জন্য এক সাংস্কৃতিক লড়াই গড়ে তুলেছিলেন এই চির চেনা মুখগুলো। ২১ টি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। চালু আছে শুধু তসবীর মহল আর মণিহার।

কীত্তর্ণখোলা নদীর তীরের শহর বরিশাল দেশের অন্যতম একটি শিক্ষা সাংস্কৃতিক চর্চার শহর হিসেবে পরিচিত। ৫৮ বর্গ কিলোমিটারে ছোট শহরটিতে এক সময় সিনেমা
হল ছিলো ৪টি। ছুটির দিনগুলোতে সিনেমা হলের সামনে দীর্ঘ সাড়ি থাকতো সিনেমা
প্রেমী দর্শকদের। এখন চিত্র ঠিক ভিন্ন। হল আছে মাত্র একটি। এমন চিত্র শুধু যশোর রাজশাহী কিংবা বরিশালের না। এই চিত্র সারাদেশেই বিদ্যমান। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমাহলগুলি। গত দুই যুগের ব্যবধানে নাই হয়ে গেছে ১২শোর উপরে সিনেমা হল। যে পরিমাণ সিনেমা হল বন্ধ হয়েছে তার সিকি ভাগও তৈরি হয়নি।
এই সিনেমা হলগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে সিনেমা সংশ্লিষ্টদের কাছ
থেকে পাওয়া যাচ্ছে নানা মত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ক্রমশই বন্ধ হয়ে
যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো।
হল মালিক সমিতির তথ্যমতে, নব্বই দশকে বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিলো
১ হাজার ৪৩৫ টি। গত দুই যুগের ব্যবধানে হলের সংখ্যা ১৭০টি। বন্ধ হয়ে গেছে ১২শ ৬৫টি সিনেমা হল। চালু থাকা ১৭০ টির ভেতর নিয়মিত চালু আছে ১১০ টি সিনেমা হলো। বাকি ৬০ টি সিনেমা হলে নিয়মিত সিনেমা প্রর্দশিত হয় না।

সিনেমাকে বাঁচাতে হলে প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাতে হবে বলে মনে করছেন পরিচালক
সমিতির মুশফিকুর রহমান গুলজার। এই নির্মাতা বাংলা’কে বলেন, ‘আসলে সিনেমা
চালিয়ে এখন হল মালিকরা লাভবান হতে পারছেন না। তাই হল ভেঙ্গে মালিকরা
মার্কেট বানাচ্ছেন বা অন্য ব্যবসা করছেন। হল না থাকলে সিনেমা কীভাবে
দেখবে মানুষ? তাই যেকোনো ভাবে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে হবে। এভাবে দিন দিন
হল কমতে থাকলে ভবিষ্যতে বড় সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে,
সিনেমার হল উন্নয়নে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হলে
আশাকরি আগামী দুই বছরের মধ্যে সমস্যা কেটে যাবে।’
প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ও প্রযোজক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ মনে করেন
সিনেমাগুলো ব্যবসা করতে পারছে না বলেই সিনেমা হল উঠে যাচ্ছে। তিনি

বলেন, ‘দু-একটা ছবি বছরে ব্যবসা করছে। বাকিগুলো দর্শক নিচ্ছে না। ভালো
ছবি নির্মাণ হচ্ছে না । তাই বাধ্য হয়েই হল বন্ধ করছে অনেকে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সিনেমা এখন লাইফ সাপোর্টে আছে। কয়েকটি সিনেপ্লেক্স বানান হয়েছে। শুধু সিনেপ্লেক্স বানালে হবে না। সবার তো সিনপ্লেক্সে সিনেমা
দেখার সামর্থ্য নেই। লোকাল দর্শকরা তো সেখানে সিনেমা দেখতে পারবেন না।
তাই যেই হলগুলো আছে সেগুলো ঠিক করে আধুনিক করতে হবে। আর যদি দিন দিন হল
হারাতে থাকে বিশাল সংকটে পড়তে হবে, এটা নিশ্চিত।’

চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগঠক বেলায়েত হোসেন মামুন বলেন, ‘দর্শকের জীবন মানের পরিবর্তনের সাথে সাথে রুচিবোধেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে যে মানের সিনেমা হওয়া উচিত, সেটা খুবই কম হচ্ছে। দর্শক তার মনের মতো সিনেমা পাচ্ছেন না। তাই তারা হলে যেতে ইচ্ছুক হচ্ছে না।
দর্শক যেহেতু যাচ্ছে না তাই হলগুলো টিকে থাকতে পারছে না। এছাড়া চারদিকে নানা প্রযুক্তি ছড়াছড়ি। মানুষ ঘরে বসেই এখন সিনেমা দেখতে পাচ্ছে। যাই হোক, হল সংকট বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। অনেক দিন ধরেই এই সমস্যা চলছে।
আমার কাছে মনে হয়, নতুন কিছু ভাবতে হবে এই সংকট উত্তরণের জন্য।’