সময় ও জলস্রোতে কারো জন্য থেমে থাকেনা। অবিরাম তার চলার গতি।
মানুষের জীবন ধারাও তেমনি। জীবন মানেই চলমান। এই চলমান জীবন ধারায় উত্থান পতন আছে। আছে সুখের অনাবিল ধারা, আবার কখনো দুঃখের ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন মূহুর্ত। সুখ এবং দুঃখ কখনো ক্ষণিকের
আবার কখনো স্থ্য়াী- দীর্ঘস্থায়ী হয়। দীর্ঘস্থায়ী দুঃখের অমানিষার অন্ধকার সাজানো -গোছানো জীবনকে লন্ড-ভন্ড করে দেয়। করো জীবনে আর এ অন্ধকারের অমানিষার ভোর হয়না। সারা জীবন সেই দুঃখ মানব
জীবনকে কুরে কুরে খায়। তবুও মানবের চলমান জীবন ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হলেও একেবারে থেমে থাকেনা।
বলছিলাম বিশ^ব্যাপি করোনাভাইরাস বাকোভিড-১৯ এর নির্দয় ছোবলের কথা। চীন দেশের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হওয়া এক অদৃশ্য- অস্পৃশ্য শত্রুর আক্রমণ সমগ্র বিশ^কে, বিশে^র লাখো লাখো মানুষের
জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। বিশ^ব্যাপি যখন করোনাভাইরাসের মির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ ঠিক সেই সময় বিশে^র মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন এসে উপস্থিত। আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) দ্বিতীয় হিজরীতে পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম
সাধনার পর শাওয়াল মাসের চাঁদ উদিত হবার পরদিন মসজিদে নববীর অদুরে, বাস গৃহ থেকে হাজার গজ পশ্চিমে খোলা জায়গায় ঈদের নামাজ আদায়
করেন। হযরত মোহাম্মদ (সা.) জামাতে ইমামতি করেন। সেই থেকে মুসলমানদের জন্য ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায়ের সুচনা হয়।
বাংলার বুল বুল বিদ্রোহী কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিষ্য, শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ এর অনুরোধে ১৯৩১ সালে
কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক লেখা ও সুর সংযোজনা করা ঈদুল ফিতরের
সেই প্রখ্যাত গান ‘‘ রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/
নিজেকে তুই বিলিয়ে দে আজ আসমানি তাগিদ….।’’ আবার অন্য এক গীতিকারের লেখা ‘‘ ঈদ এলোরে, ঈদ এলোরে, ঈদ এলোরে ভাই / চলো
সবে ঈদগাহেতে নামাজ পড়তে যাই..। ’’ এবারের করোনাকালিন জীবন ধারায় ঈদগাহে যাওয়া হলোনা। হলোনা নামাজ শেষে মোসাফা ও কুলাকুলি করা। এবার করোনার কারণে ঈদের নামাজ আদায় করতে হলো মসজিদে মসজিদে। শুধু আমাদের দেশে নয় এবারের ঈদের খুশি সারা বিশে^র মুসলমানদের নিকট নিরানন্দ-আর বিবর্ণ একটি ঈদ।
অন্যান্য বছর ঈদ আসে খুশির বারতা নিয়ে। দীর্ঘ ১ মাস সিয়াম সাধনা শেষে মুসলিমদের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপনের মধ্য দিয়ে মুসলিম ভাতৃত্ববোধ আরো সুদৃঢ় হয়।
বিশে^র প্রায় ১ শ ৮০ কোটি মুসলিম এই উৎসবে মেতে ওঠে। ঈদ মুসলিম উম্মাহর জাতীয় উৎসব। ঈদুল ফিতরের দিন প্রতিটি মুসলমান নারী-পুরুষের জীবনে অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। ঈদুল ফিতর প্রতি বছর ধরনীতে এক আনন্দ–বৈভব বিলাতে ফিরে আসে। রহমত, মাগফিরাত ও
নাজাতের মাস রমজানের সিয়াম সাধনার শেষে শাওয়ালের এক ফালি উদিত চাঁদ নিয়ে আসে পরম খুশির ঈদ। প্রকৃতপক্ষে ঈদ ধনী-দরিদ্র, সুখি-
অসুখি, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সব মানুষের জন্য কোন না কোনভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দধারা।
এসময় মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে বয়ে যায় আনন্দোর জোয়ার। ঘরে ঘরে পথে পথে ছড়িয়ে পড়ে এই আনন্দ। মুসলিম দেশ ছাড়াও অমুসলিম
দেশগুলোতেও চলে খুশির রথযাত্রা। বাহারি রঙের পোষাকে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে আদর আপ্যায়ন ও অনুষ্ঠান চলে।
মুসলিম জাহানের তীর্থস্থান সৌদি আরব। সেখানে ঈদ ইদযাপিত হয় জৌলুস আর জাঁকজমকপুর্ণ ভাব নিয়ে। ঈদের আগমণি বারতার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর করে সাজানো হয় ঘর-বাড়ি। আয়োজন করা হয় ভুরিভোজের।
ঈদ সেলামি আদায়, অতিথি আপ্যায়ন,নতুন পোষাক পরা –সবই চলে।
শিশুদের মাঝে খেলনা ও উপহার সামগ্রি বিতরণ করা হয় বিশে^র সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ ইন্দোনেশিয়া। আর তাই সেখানে
ঈদ উৎসবের আয়োজ হয় ঘটা করে। এখানকার মুসলমানরা ঈদের দিন শার্ট-প্যান্ট ও কালো টুপি পরে থাকেন। নারীরা বাজু কুরুং ও বাজু
কেবায়া নামের গলা থেকে পা পর্যন্ত এক ধরণের স্কাট পরেন। ঈদের দিনের বিশেষ খাবার হিসেবে তারা রান্না করে ‘কেতুপাত, দোদল, লেমাং নামের
ঐতিহ্যবাহি খাবার। ঈদের নামাজ শেষে স্বজনদের কবর জিয়ারত করার রীতি আছে তাদের মধ্যে। এদিন শিশুরা নানারকম খেলা ও ঘোরাঘুরিতে মেতে থাকে।
তুরস্কেও জাকজমকভাবে ঈদ উৎসব পালিত হয়। ঈদুল ফিতরের ছুটিকে তুরস্কে বলা হয়‘ শেখার বায়রামা’ বা রমজান বায়রামা।’ নগরীর বুø
মসজিদের মিনার থেকে শুরু করে পুরো মসজিদ আলোকসজ্জায় সাজানো হয়। ঈদের দিন সকালে গোসল করে নতুন পোষাক পরিধান করে
মসজিদে নামাজ আদায় করতে যান। নামাজ শেষে একে অন্যের বাড়িতে বেড়াতে যান। কবরস্থানে গিয়ে পূর্বসুরিদের জন্য দোয়া কামনা করেন।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ধনী দেশ মালয়েশিয়ার মুসলমানেরা অতি জাকজমকের সাথে ঈদুল ফিতর পালন করে থাকে। এদিন পুরুষেরা পরে শার্ট
আর প্যান্ট এবং মাথায় দেয় কালো রঙের টুপি। ছেলে- বুড়ো সবাই ঈদগাহে নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে বুকে বুক মিলিয়ে কুলাকুলি করে।
ইরাকে ঈদের দিন সুগন্ধি সাবার মেখে গোসল করার পর সবাই শির-খুরমা দিয়ে মিষ্টি মুখ করে। খাবারের তালিকায় বাদাম, খেজুর ও অন্যান্য খাবারও
থাকে। এরপর নতুন পোষাক পরে ছোট-বড় সবাই ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদে যায়। তাদের খাবারের তালিকায় থাকে মজাদার সব মাংসের পদ আর ডেজার্ট। ফিলিস্তিন এ ঈদের বিশেষ আকর্ষণ হলো ভেড়ার মাংস।
সামর্থবানরা আস্ত একটা ভেড়া দিয়ে রোস্ট করে। বাকিরা মানসাফ নামে ভেড়ার মাংসের ডিশ রান্না করে। নামাজ শেষে সবাই ঘুরতে বের হয়।
একে অপরের বাড়িতে যায়। এবারের করোনাকালের জীবন ধারায় গোটা বিশে^র মুসলমানদের নিকট ঈদুল ফিতরের আনন্দ ফিকে ও বিবর্ণ হয়ে
দেখা দেয়। (চলবে)
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।