করোনা কালের জীবন ধারা- ১৬

কি যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে করোনাকালের জীবনধারায়। অজানা এক অদৃশ্য আতঙ্কে কাটছে মানুষের দিন কাল। এর বুঝি আর শেষ নেই। নেই পরিসমাপ্তি। সারা বিশ^ জুড়েই করোনা আতঙ্ক। কোথাও কোথাও আইসোলেশন, কোথাও কোয়ারেন্টিন আবার কোথাও হোম কোয়ারেন্টিন। আর সারা দেশ জুড়ে লকডাউন তো রয়েছেই। আরো
আছে সাবান পানি দিয়ে ঘন ঘন দুহাত ধোয়া। সকল সময় গৃহ বন্দি বা ঘরবন্দি অবস্থায় থাকা। হ্যান্ড সেনিটাইজার দিয়ে বার বার হাত
মোছা। আর কদাচিৎ বাইরে গেলে মুখে মাস্ক পরা। সামর্থ থাকলে হাতে হ্যান্ড গ্লাভস। বাইরে থেকে ঘরে ফিরে সাবান দিয়ে গোসল। এসবই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা। বলতে গেলে ঢাকা মহাখালির স্বাস্থ অধিদপ্তর
থেকে প্রতিদিন দুপুর আড়াইটার সময় কোভিড-১৯ ব্যুলেটিন প্রচার করা হয়। কম বেশি সকলেই যেন ‘‘ স্টেশনের রেল গাড়িটা মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা/প্লাটফরমে বসে ভাবি কখন বাজে বারোটা।’’ ঐ ব্যুলেটিন শোনার জন্য অধির আগ্রহে বসে থাকে, কখন বাজে
আড়াইটা। এপর্যন্ত কোনদিন আড়াইটার স্বাস্থ্য ব্যুলেটিন কোন ভালো খবর দিতে পারছেনা। ক্রমেই কোভিট-১৯ অক্টোপাশের মত মানুষকে
নাস্তানাবুদ করতে ভীষণভাবে তৎপর। দিবা-নিশি করোনার ভয়। তার মানে
করোনার ভয় সহসা পিছু ছাড়ছেনা। এ জ¦ালার যেন শেষ নেই। বাংলাদেশের
খ্যাতনামা গীতিকার ও গায়কের গান “ আমার ঘরেও জ¦ালা- বাইরেও জ¦ালা
/জ¦ালা রাইতে দিনে” এর মত যেন ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা।
লকডাউন পালনকালে বাসায় থাকতে থাকতে বাসা-বাড়ির সদস্যদের
কারো মাঝে হঠাৎ যদি স্বর্দিজ¦র দেখা দেয় তো আর নিস্তার নেই। কাশি
আর গলা ব্যাথা হলো তো কোন কথাই নেই। ক্রমেই পরিস্থিতি ঘোলাটে
হতে থাকে। মা-বাবা ছেলে-মেয়েকে, ছেলে-মেয়ে মা-বাবাকে, স্বামী
স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। এই বুঝি
বাসায় করোনা ঢুকে পড়েছে। শুধু কি তাই একে অপরের মধ্যে সন্দেহ
আর দুরত্ব বেড়ে যায়। ব্যক্তিটি তখন নিজেও করোনা আতঙ্কে করুনার পাত্র
হয়ে দাঁড়ায়।
ষাটের দশকে পাবনা আরএম একাডেমিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় দেশে
হায়নার ভয় এসেছিলো। অদৃশ্য সেই আজব জীব হায়নাকে কেউ
কোনখানেই দেখেনি অথচ সেই হায়নার ভয়ে সকলেই যেন কুপোকাত।
এই হায়নাকে নিয়ে একটি রম্য রচনা লিখেছিলাম। সেসময় আরএম
একাডেমি বার্ষিকীতে সেটি ছাপা হয়েছিলো। তারই সামান্য অংশ
তুলে ধরা হলোঃ- কেউ দেখেনি সেই আজব চিজ হায়না। কিন্তু হায়নার
ভয়ে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। রাতে কেউ রাস্তা-পথে সহজে বের
হয়না। রাতের বেলা ঘুমের ঘোরে স্বামীর হাত যদি স্ত্রীর গায়ে লাগে তো
হায়না হায়না করে চিৎকার করে পাড়াশুদ্ধ লোকজন জড়ো করে ফেলে। ঠিক
তেমনি করোনার দিনে কারো হঠাৎ জ¦র ও শ^র্দি-কাশি হলে কোনমতেই
চাপা থাকেনা। নিমিষেই পাড়াময়. গ্রামময় তা ছড়িয়ে পড়ে। করোনা
আক্রান্তের কথা প্রশাসনের কানে চলে যায়। আশে পাশে ফেসবুক ধারি
থাকলেতো কোন কথাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে তা ফেসবুকের মাধ্যমে
ছবিসহ ভাইরাল হয়। পারলে সে বাসা-বাড়ির ভিডিও ফুটেজও প্রকাশ করা
হয়।
অবশেষে ব্যক্তির জন্য আইসোলেশন, আর বসতবাড়ি বাধ্যতামুলকভাবে
লকডাউনের আওতায় চলে যায়। রাজধানী ঢাকা কিংবা আশে-পাশের জেলার
বাসিন্দা হলে সহজেই করোনা পরীক্ষা করিয়ে পজেটিভ -নেগেটিভের পর্ব
চুকে যায়। নেগেটিভ হলে রাজ্য জয়ের মত বিজয়ী আর পজেটিভ হলে তো
সর্বনাশ। আর এটা যদি ঢাকার বাইরে মফস্বল এলাকায় ঘটে তাহলে মরার
উপর খাঁড়ার ঘা।
ব্যক্তি যদি সমাজের বুকে নামি-দামি হয় তো প্রশাসনিক কর্মকর্তা
থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে
তার বাসায় ওষুধ-পথ্য, ফল-মুল ও বিভিন্ন পদের খাদ্যদ্রব্য উপহার হিসেবে
পাঠিয়ে থাকে। ঘটা করে সেসবের ছবিও ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকে আপলোড করা হয়। কেউ কেউ আবার করোনা রোগির খাদ্য তালিকা না
জেনেই ফল-মুল ও খাদ্যসামগ্রি পাঠিয়ে থাকেন, তাও আবার নিষিদ্ধ
ঘোষিত পলিথিন ব্যাগে পুরে।
রোগির রোগ যদি গুরুতররূপে আত্মপ্রকাশ করে তাহলে তাকে এম্বুলেন্সে
করে করোনা হাসপাতালে পাঠানো হয়। পাঠানোর সময় যেন তাকে চির
জনমের মত বাড়ি থেকে বিদায় করা হলো এমনি অবস্থার সৃষ্টি হয়।
পৌরাণিক কাহিনীতে আছে চাঁদ সওদাগরের পুত্র লক্ষিনদার তার স্ত্রী
বেহুলাকে নিয়ে বাসর ঘরে অবস্থানের সময় মনষা দেবি স্বর্প হয়ে দংশন
করার পর উপায় অন্তর না দেখে তাকে কলাগাছের ভেলায় করে নদীতে
ভাসিেেয় দেওয়া হয়। তার নববিাহিত স্ত্রী বেহুলা তার স্বামীর সঙ্গে কলার
ভেলায় ভাসতে ভাসতে অজানার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। করোনায় কোন কোন
পরিবারের স্বজনকে এমনিভাবে বিদায় করা হয়।
আবার ফকির লালন সাঁইজি তরুন বয়সে একবার তীর্থ ভ্রমণে বের হন।
পথিমধ্যে তিনি গুটি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। সাথিরা তাকে মৃতভেবে
পরিত্যাগ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা
লালনকে উদ্ধার করেন মলম শাহ এবং তার স্ত্রী মতিজান। তাকে বাড়িতে
নিয়ে সেবা-যতœ করে সুস্থ্য করে তোলেন।
কিন্তু বর্তমানে করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি থেকে বের করে
দিবার পর একমাত্র মোবাইল ফোন ছাড়া তার সম্মুখ সাক্ষাতে খোঁজ খবর
নেয়ার আর কোন সুযোগ থাকেনা। বিদায়ের সময় রোগির সঙ্গে
বাসা-বাড়ির আপনজনের যাওয়া বারন। করোনার ছোঁয়ায় তার যদি করোন
হয়! রোগিকে নিতে আসা ডাক্তার, নার্স , আয়া এবং এম্বুলেন্স চালক
প্রত্যেকের জন্যই পিপিই ,মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, চশমাসহ প্রয়োজনীয়
পোশাকে শরীর ঢাঁকা আবশ্যক। তারা রোগীকে বার বার অভয় দিয়ে নিয়ে
যান। যেন যমদুতের বাড়িতে পায়ে হেঁটে গমণ।
করোনায় আক্রান্ত রোগি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার সময় সে বিজয়ী বীর
হয়ে যায়। করোনা যুদ্ধের সে একজন বীর পুরুষ। হাসপাতালের গেটে
হাততালি দিয়ে বিদায় করা হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে আবার ফুলও ছিটানো হয়। আর তার নসিবে যদি মৃত্যু লেখা থাকে তো পরিবারের সদস্যদের জন্য
আর সে লাশ দেখার ভাগ্য হয়না। নিজ ঘরের অতি আপন জনের লাশ তখন আর
আপন থাকেনা। সে লাশ তখন মানুষ থেকে করোনায় পরিণত হয়। (চলবে)
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১