বিশ্ব মা দিবসে সকল মার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ

মা শব্দটির সাথে যেন মানসনেত্রে ভেসে উঠে এক মমতাময়ীর ছবি। মা মানেই শ্রদ্ধা, স্নেহ, মায়া, মমতা আর ভালোবাসার আশ্রয়।মা মানেই পুজনীয়। আজ ১০ মে বিশ্ব মা দিবস।এ দিবসটিতে বিশ্বের সকল মায়ের প্রতি জানাই কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। এ দিনটিতে মাকে আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন,মাতৃত¦,মাতৃক ও সমাজে মায়েদের প্রভাবের জন্য উদযাপন করা হয়ে থাকে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও করোনার প্রভাবে দিবসটি লোকচক্ষুর অন্তরালে পালিত হতে চলছে । দিবসের সুচনা যেভাবে হয়।
মা দিবস পালনের রেওযাজ সেই প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসছে।আর এটা প্রথা হিসেবে গ্রিসের মাতৃ আরাধনা থেকে এসেছে বলে মতবাদ রয়েছে।যেখানে গ্রিক দেবতাদের মধ্যে বিশিষ্ট দেবী সিবেলকে মা রুপে আরাধনা করা হতো।হিন্দু শাস্ত্রে ও মার আরাধনার পরিচয় মেলে। তবে আধুনিককালে আমেরিকাতেই মা দিবসটি গ্রথম চালু হয়।

১৯০৫ সালে যুক্তরাষ্টের এক মা অ্যানা রিভিজ জারভিস তার স্কুলে প্রথম মা দিবস চালু করেন। ১৯১৪ সালে ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের ২য় রবিবারকে মা দিবস ঘোষণা করা হয়। এ দিবসে মা আমেরিকায় ছুটি দেয়া হয়। এখন বিশে^র ৫০ টির ও বেশি দেশে মা দিবস পালিত হয়ে আসছে। মা দিবস পালনের সাথে মার্কিনি কয়েক নারীর দীর্ঘ ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। আমেরিকান সমাজ কর্মী জুলিয়া ওয়ার্ড হোই নামক এক নারীর হাত ধরে মা দিবস যেন আনুষ্ঠানিকতা পায়।মা দিবসের প্রথম চিন্তা আসে অ্যানা রিভম জারভিসের মাথায়।তার মেয়ের নাম অ্যানা মেরি জারভিস।

মেরি জারভিসের মা শিক্ষকতা করতেন।তিনি মা’দের জন্য মাদার্স ডে ওয়ার্ক ক্লাব গড়ে তোলেন।এ ক্লাব গড়ার উদ্দেশ্য হলো শিশুদের যত্ন নেয়ার ব্যাপারে মা’দের জানানো। ১৮৭০ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পৈশাচিকতা ছাড়িয়ে গেলে শান্তির প্রত্যাশায় সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ড হোই মাদারর্স ডে প্রোক্লোমেশন নামে ঘোষণাপত্র লেখেন।এ ঘোষণায় জুলিয়া রাজনৈতিক স্তরে সমাজ প্রতিষ্ঠায় নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। যুদ্ধশেষে পরিবারহীন অনাথদের সেবা ও একত্রীকরণে নিয়োজিত হন মার্কিন সমাজকর্মী আনা রিভিজ জারভিস ও তার মেয়ে অ্যানা মেরি জারভিস।

১৯০৫ সালে মারা যান অ্যানা মেরি জার্জিসের মা। ১৯০৬ সালে ১০ মে সকালে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রাফিউন শহরের আন্দ্রেউজ মেতউসই এপিসকোপাল চার্চে প্রথম বারের মতো মাকে স্মরণে মা দিবস পালন করা হয়। তা পালন করেন মেয়ে আনা জারভিস বন্ধুদের নিয়ে। সেখানে অ্যানা মেরি জারভিসের মা প্রতি রবিবার পড়াতেন। এ চার্চটি বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল মাদার্স ডে শিরিন নামে পরিচিত। অ্যানার মার আশা ছিলো মা’দের নামে একটি দিবস প্রতিষ্ঠা করা হোক। তাই মায়ের মৃত্যুর পর মেয়ে অ্যানা মেরি জারভিস সে কাজে নেমে পড়েন।

১ বছর তিনি প্রশাসকদের কাছে এ নিয়ে চিঠি চালাচালি করেন। তিনি মার্কটোয়েন,থিওডর রুজভেল্ট থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের কাছে চিঠি পাঠান।তার ২ বছর পর অ্যানা মেরি জারভিসের কথা অনুযায়ি ভার্জিনিয়াতে দিনটি পালনে ছুটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু অ্যান মেরি জারভিস থামেনি।তার প্রত্যাশা মার মৃত্যুর দিনটা যেন জাতীয় দিন ঘোষণাসহ ছুটি দেয়া হোক।অবশেষে আমেরিকা কংগ্রেস মে মাসের ২য় রবিবারকে মা দিবস হিসেবে গন্য করে বিল পাশ করেন।১ম মা দিবসটি উৎসর্গ করা হয় সে সব মা’দের যারা যুদ্ধে তাদের সন্তানকে হারিয়েছেন।কিন্তু সবার কাছে দিনটি হয়ে উঠে ব্যবসা নির্ভর।

এ দিবসটিতে সারা বিশ্বে ফুল,কার্ড আর উপহার সামগ্রির ব্যাপক ব্যবসা হয়ে থাকে।বড়দিন ও ভালোবাসা দিবসের পরেই এদিনটি পালিত হয়ে থাকে। এদিনটিতে ইউরোপ আমেরিকার ছেলেরা ফুল ও উপহার সামগ্রি নিয়ে মায়েদের সাথে হোটেলে খেতে যায় ও সময় কাটায়। তাদের দেশের প্রথা অনুসারে ছেলে মেয়েরা এডাল্ট হলে তারা তাদের ইচ্ছা মতো থাকার অধিকার পান। তাই অধিকাংশ ছেলে মেয়েরা মা বাবাকে রেখে অন্যত্র বাস করে। মা দিবসে সন্তানরা কারনেশন ফুল ও নানা উপহার নিয়ে মা’র সাথে সময় কাটায়। মা দিবসের প্রতীক ধরা হয় সাদা কারনেশন ফুলকে।পৃথিবীর কয়েকটি দেশ অন্য তারিখে মা দিবস পালন করে আসছে।এর মধ্যে নরওয়ে মার্চ মাসের ৪র্থ রবিবার,আয়ারল্যান্ড,নাইজেরিয়া,যুক্তরাজ্য ফেব্রুয়ারি মাসের ২য় রবিবার পালন করে।আর বেশিরভাগ দেশই মে মাসের ২য় রবিবার মা দিবস পালন করে আসছে।

আমাদের বাংলাদেশে ও মা দিবস ৩ দশক ধরে পালিত হচ্ছে। লিখতে বসে আমা মনে বেশ কিছু প্রশ্ন জাগছে। আমাদের দেশে মা দিবস যুগ যুগ ধরে পালিত হলেও সন্তানদের কী মা’র প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা বেড়েছে? দরিদ্র থেকে শুরু করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ বিত্তের পরিবারের পর্যবেক্ষণে আমরা কী দেখতে পাই? দরিদ্র পরিবারে অভাবের তাড়নায় না হয় অনেক পরিবারের সন্তানরা মা’ক দেখেন না। তাদের ভাত কাপড় দেন না। আবার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অবস্থাটাও আশাপ্রদ নয়। একান্নবর্তি পরিবার আজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়েছে। পরিবারের সন্তানরা যে যার মতো পৃথক সংসার করছে।
আর সে সব পরিবারে মা যেন বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে। তাই মাকে একেক ছেলের বাড়িতে যেন বুড়ো বয়সে কাজ করে খেতে হচ্ছে।

এক ছেলের বউ’র ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে মা অন্য ছেলের বাড়িতে যাচ্ছে। আবার কয়েকদিন পর তারা ও বিরক্তি প্রকাশ করায় তাকে অন্য ছেলের বাড়িতে যেতে হচ্ছে। এসব মা’দের অবস্থা ভাগের মা গঙ্গা পায় না প্রবাদেও মতো।এরকম অধিকাংশ ছেলেরাই মার এ অবস্থায় তারা ভাবে কোন কুল রাখবো- মা না বৌ। তাই বৌয়ের এক একটা ভাড় ছেলেরা বউকে না চটিয়ে মাকে বিদায় করে যেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন। আর বউরা হাফ ছেড়ে বাঁচেন যাক আপোদ তো বিদায় হলো। তাদের কাছে শাশুড়ি হলো আপোদ। তাদের মাকে যদি তাদের ভাই বৌরা এমনটি করতো তাহলে তাদের মুখ দিয়েই কতই না নীতি কথার ফুঁলঝুড়ি উড়তো। আবার উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত অনেক মানুষ নামের অমানুষকে আমরা দেখি যাদের বাড়িতে তথা ফ্ল্যাটে জন্মদাত্রী মায়ের এতটুকু জায়গা হয় না।

স্ত্রীদের রক্তচক্ষুর ভয়ে নুপংসুক সে পুরুষরা তাই মাকে অনাথ আশ্রম বা বৃদ্ধা আশ্রমে পাঠিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুম পাড়ে। এরা কখনও শিক্ষিত হতে পারে না। এরা মুর্খের চেয়েও অধম। আমার মনে হয় যারা স্ত্রীর কথায় উঠ বস করে সে সব পুরুষ নামের কলঙ্ক স্বামীরা কখনও তার জন্মদাত্রী মাকে সম্মান দিতে পারেন না। তারাই মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় বা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়। সে কী কখন ও চিন্তা করে তার পরিনতি কি হবে? তার সন্তানরা ও তাকে নিশ্চিত বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে এ চিন্তা কি এসব সন্তানরা করছে? যদি করতো তাহলে সন্তান অবশ্যই মা বাবাকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে সারা জীবন তাদেও সেবা করতেন।

কিন্তু কয়জন করে?আর একটি কথা না বললেই নয় শুধু একটিমাত্র দিনে তো মাকে সম্মান জানানোর কিছু তো দেখি না।এদিনটিতে না হয় একটু বিশেষভাবে পালন করা যায়। কিস্তু মাকে সম্মান জানানো আদর ভালোবাসা প্রতিটি দিনের প্রতি মুহুর্তেই সন্তানের জন্য অপরিহার্য। যার জন্য গৃথিবীর এ মুখ দর্শন তাকে অবহেলা অবজ্ঞা করলে সে সন্তানের জন্য ও অনিবার্য় পরিণতি অপেক্ষা করে থাকে তা আমরা এ জগতেই অনেক দেখছি। আপনি যদি আপনার মা বাবাকে অবহেলা অনাদরে রাখেন তা হলে আপনার সন্তানও আপনাকে অনাদর অবহেলায় রেখে আপনাকে বুঝিয়ে দিবে আপনি কত বড় সর্বনাশা ভুল নয় পাপ করেছেন? সেদিন আর আপনার শুধরানোর কোন সুযোগ থাকবে না। তাই সাধু সাবধান।

কৃষ্ণ ভৌমিক
পাবনা।