দেশের বিভিন্ন স্থানে জ্বর-সর্দি ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা নিয়ে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাস্থলসমূহ হচ্ছে— কুষ্টিয়া, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, যশোর, দিনাজপুরের বিরামপুর ও শেরপুরের নালিতাবাড়ী। কোথাও কোথাও এসব মৃত্যুর খবরে এলাকায় করোনার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, কোথাও আবার বাড়ি বা পুরো গ্রাম লকডাউন করা হয়েছে। আর নিউমোনিয়া জাতীয় কোনো অসুখের খবর শুনলেই রোগীকে চিকিত্সার জন্য হাসপাতালে নেওয়া ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে। যশোরে জ্বরে আক্রান্ত এক নারী হাসপাতালে যেতে চাইলে কোনো যানবাহনই তাকে নিতে চায়নি। এমনকি একটি অ্যাম্বুলেন্স এলেও রোগের লক্ষণ শুনে পালিয়ে যান চালক।
কুষ্টিয়ায় সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত এক ইজিবাইক চালকের (৪০) মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল ৭টার দিকে ঐ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা তাকে কুষ্টিয়া ২৫০ বেড জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনার পর চিকিত্সকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি শহরের চৌড়হাস এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ২৭ মার্চ শুক্রবার ঐ ইজিবাইক চালক জ্বর-সর্দি,কাশিতে আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। এক পর্যায়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ ও নিস্তেজ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে আনার আগেই ঐ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তিনি করোনা ভাইরাস আক্রান্ত বলে চিকিত্সকরা ধারণা করছেন।
কুষ্টিয়া ২৫০ বেড জেনারেল হাসপাতালের আএমও ডাক্তার তাপস কুমার সরকার জানান, মৃত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষাগারের ফলাফলে তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে। তবে লক্ষণ অনুযায়ী প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে—তিনি করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী ছিলেন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্দেশনা অনুসরণ করে লাশ দাফন সম্পন্ন করা হবে বলেও তিনি জানান। ইজিবাইক চালক বিদেশি কারোর সংস্পর্শে ছিল না কিংবা তার পরিবারে কোনো প্রবাসীর বসবাস ছিল না। কুষ্টিয়া শহরেই তিনি ইজিবাইক চালাতেন। গাড়ি নিয়ে চলাচলের সময় করোনা ভাইরাসের বাহক কারো সংস্পর্শে তিনি সংক্রমিত হতে পারেন বলে চিকিত্সকরা ধারণা করছেন। এদিকে সতর্কতা হিসেবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঐ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা কয়েক জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। নমুনার প্রতিবেদন না পাওয়া ঐ বাড়িটি লকডাউন থাকবে।
অন্যদিকে, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম (৬০) মারা গেছেন। টানা ১০ দিন জ্বর-সর্দি নিয়ে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তিনি সোমবার সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলায়। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণের সকল উপসর্গগুলো ছিল। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় কোনো চিকিত্সক তাকে চিকিত্সা দেয়নি। পরে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তার ছেলে মাহফুজ বলেন, বাবা হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। পাঁচ দিন ঐ হাসপাতালে ছিলাম। ভালো চিকিত্সা পাইনি। এর আগে কয়েকটি হাসপাতালে নিয়েছিলাম। হাজীগঞ্জ বাজারে তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে করোনা আতঙ্ক শুরু হয়।
এদিকে, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সোহাগ হোসেন (১২) নামে এক শিশু মারা গেছে। এলাকাবাসীর ধারণা তার মধ্যে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ ছিল। সোহাগ রবিবার রাত সাড়ে ৩টায় প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে গজারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়। পরে সোমবার ভোরে ঢাকা নেওয়ার পথে সে মারা যায়। পরে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় স্থানীয় কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
মুন্সীগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, জ্বর নিয়ে রবিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে সোহাগকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শ্বাসকষ্ট বা সর্দি-কাশি ছিল না। তার বেশ জ্বর ছিল এবং ঘাড় বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল।
পৃথক ঘটনায় দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার পল্লীতে জ্বর, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা গেছেন ফরহাদ হোসেন (৪০) নামে এক ব্যক্তি। করোনা ভাইরাস সন্দেহে মৃত ঐ ব্যক্তির গ্রামের ৩০টি বাড়ির প্রায় দেড়শত মানুষকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। সোমবার ভোরে বিরামপুর উপজেলার জোতবানী ইউনিয়নে আঁচলকোল তফসীগ্রামে তার মৃত্যু হয়।
তার পরিবার সূত্রে জানাযায়, চলতি মাসের কুমিল্লার স্থানীয় তিন যুবকসহ কাজের সন্ধানে যান। সেখানে গিয়ে তার শরীরে জ্বর অনুভব হলে এলাকায় ফিরে আসেন। সর্বশেষ সোমবার ভোর রাতে নিজ বাড়িতেই মারা যায়।
দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুল কুদ্দুছ জানান, ঐ ব্যক্তি কুমিল্লার এক প্রবাসী ফেরত নাগরিকের বাসায় কাজ করতেন। জ্বর, সর্দি ও কাশি নিয়েই তিনি সাত দিন আগে কুমিল্লা থেকে ফিরেছেন।
এছাড়া, শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের দক্ষিণ পলাশীকুড়া গ্রামের আব্দুল আওয়াল (৫৫) নামের এক ব্যক্তি রবিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে মারা গেছেন।
তিনি গত তিন-চার দিন ধরে জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তিনি বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় পাইলিং কনস্ট্রাকশনের নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত চার দিন আগে সাধারণ ছুটি পেয়ে তিনি বাড়িতে আসেন। বাড়িতে আসার পর থেকেই তার জ্বর ও শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। এরপর তিনি স্থানীয় ফার্মেসি থেকে শ্বাস কষ্টের ওষুধ ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এতেও তার শ্বাসকষ্ট না কমায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর রবিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
এদিকে, মৃত ব্যক্তির জ্বর ও শ্বাসকষ্ট থাকায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন বলে ধারণা করেন গ্রামবাসী। তবে ঐ পলাশীকুড়া গ্রামের ইউপি সদস্য নুরুল হক তার পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে বলেন, আব্দুল আওয়াল অনেক আগে থেকেই শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। ছুটিতে বাড়ি আসার পর হঠাত্ করে শ্বাসকষ্ট ও জ্বর বেড়ে যাওয়ায় নিজ বাড়িতেই তার মৃত্যু হয়। এতে গ্রামবাসী তাকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে সন্দেহ হয়।
এ ব্যাপারে শেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. আনোয়ারুর রউফ জানান, আপাতত ঐ ব্যক্তির সংস্পর্শে যারা ছিলেন তারাসহ আশপাশের ১০টি বাড়ি লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া নিয়ম মেনে তার দাফন কাফনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জেলার ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
যশোর অফিস জানায়, যশোরে হোম কোয়ারেন্টাইন শেষে মালয়েশিয়া ফেরত ইউপি সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা (৬০) সোমবার সকালে উজ্জ্বলপুর গ্রামে নিজবাড়িতে মারা যান। তিনি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্ট্রোকে গোলাম মোস্তফার মৃত্যু হলেও এ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে।
বাঁকড়া ইউপি চেয়ারম্যান নিছার আলী জানান, গোলাম মোস্তফা মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এজন্য তিনি মাঝেমধ্যে মালয়েশিয়া যেতেন। গত ১৪ মার্চ তিনি দেশে ফেরেন। এরপর থেকে উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে তিনি হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন।
অসুস্থ নারীর মিলল না অ্যাম্বুলেন্স
যশোরে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহভাজন এক নারীকে চিকিত্সার জন্য কোনো যানবাহন পাওয়া যায়নি। অ্যাম্বুলেন্স গিয়েও রোগীর অবস্থা দেখে তাকে না নিয়েই সটকে পড়েছে। এমনকি সিভিল সার্জনও ঐ রোগীর চিকিত্সার উদ্যোগ নেননি বলে অভিযোগ উঠেছে।
সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলিমুজ্জামান মিলন ইত্তেফাককে বলেন, তার ইউনিয়নের গহেরপুর গ্রামের ৩০-৩৫ বছর বয়সি ঐ নারী সপ্তাহখানেক ধরে জ্বর, কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। খবর পেয়ে তিনি সেখানে গিয়ে জানতে পারেন হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ইজিবাইক চালকের কাছে অনুরোধ করা হলেও তারা তাকে নেয়নি। শহর থেকে প্রাইভেট একটি অ্যাম্বুলেন্সও এসেছিল। কিন্তু তাকে বহন করেনি। এ অবস্থায় তিনি সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু হাসানকে ফোন করে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনিও রোগীকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। পরে তিনি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে এক জন স্বাস্থ্যকর্মীকে পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন।
স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর জানান, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে আসা দুই রোগীর মধ্যে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার ছয়আনি চরকবন্দ চাদখানা এলাকার পুলিন চন্দ্র রায় (৬০) নামে এক জন সর্দি-জ্বর-কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। গতকাল সন্ধ্যায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু চিকিত্সা না পেয়ে রাত আনুমানিক ১০টার দিকে তিনি মারা যান। স্বজনের অভিযোগ ভর্তির পর কোনো প্রকার চিকিত্সা পাননি। এমন কি কোনো চিকিত্সক পর্যন্ত যাননি।
রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমার রায় ইত্তেফাককে জানান, ধারণা করছি পুলিন চন্দ্র রায়ের যক্ষ্মা হয়েছিল। তাকে মেডিক্যালের সাধারণ ওয়ার্ডে রাত সাড়ে ৯টায় ভর্তি করা হলে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি মারা যান।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক সাংবাদিকদের জানান, মেডিক্যালের চতুর্থ তলার কেবিনকে সর্দি-জ্বর-কাশি ইউনিট করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম থেকে রংপুর মেডিক্যালে ভর্তি হওয়া এক জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষার স্যাম্পল ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ ধরা পড়েছে।
(ইত্তেফাকের সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহের প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর)