মাসুদ রানা, ভাঙ্গুড়া পাবনা ::
মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদীতে ট্রলার ডুবিতে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার ১৭ দিনমজুর নিখোঁজ হওয়ার এক বছর পার হয়েছে। গত বছরের ১৪ জানুয়ারি ভোরে মুন্সীগঞ্জের চরঝাপটা এলাকায় মেঘনা নদীতে একটি ট্যাঙ্কারের ধাক্কায় মাটির ট্রলার ডুবে ভাঙ্গুড়ার ১৭ জন সহ ২০ জন নিখোঁজ হয়। এদের মধ্যে ভাঙ্গুড়ার একজনের লাশ ছাড়া বাকিদের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। প্রিয়জনদের হারানোর ক্ষত আজও ভুলতে পারেনি স্বজনরা। প্রতিটি পরিবারে এখনও চলে শোকের মাতম। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষকে হারিয়ে অভাব-অনটন প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে আছে তাদের। একদিকে প্রিয়জনকে হারানোর শোক অন্যদিকে সংসারের অভাব-অনটনে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে পরিবারের শিশু ও বয়স্ক নারী-পুরুষ। এদিকে বছর পার হলেও এসব পরিবারের ভাগ্যে আজও জোটেনি সরকারি বড় ধরনের কোনো আর্থিক সহযোগিতা।
জানা যায়, ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের সত্তর শতাংশ পরিবার হতদরিদ্র। এসব পরিবারের পুরুষ মানুষ দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান। এলাকায় কাজ না পেয়ে তারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ সহ বিভিন্ন জেলায় মাটির ট্রলারে কাজ করতে যান। গত বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই ইউনিয়নের মুন্ডুমালা, দাসমরিচ, মাদাড়বারিয়া ও চন্ডিপুর গ্রাম থেকে অন্তত ৩০ জন পুরুষ নারায়ণগঞ্জে গিয়ে একটি মাটির ট্রলারে কাজ নেন। ঘটনার দিন তাদের ট্রলারটি কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে মাটিসহ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বক্তাবলীতে ফেরার পথে মেঘনা নদীর মুন্সীগঞ্জের চরঝাপটা এলাকায় তেলবাহী ট্যাংকারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। এতে ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের মু-ুমালা গ্রামের গোলাই প্রামাণিকের ছেলে সোলেমান হোসেন, জব্বার ফকিরের ছেলে আলিফ হোসেন ও মোস্তফা ফকির, গোলবার হোসেনের ছেলে নাজমুল হোসেন, আব্দুল মজিদের ছেলে জাহিদ হোসেন, নূর ইসলামের ছেলে মানিক হোসেন, ছায়দার আলীর ছেলে তুহিন হোসেন, আলতাব হোসেনের ছেলে নাজমুল হোসেন, লয়ান ফকিরের ছেলে রফিকুল ইসলাম, দাসমরিচ গ্রামের মোশারফ হোসেনের ছেলে ওমর আলী ও মান্নাফ আলী, তোজিম মোল্লার ছেলে মোশারফ হোসেন, আয়ান প্রামাণিকের ছেলে ইসমাইল হোসেন, সমাজ আলীর ছেলে রুহুল আমিন, মাদারবাড়িয়া গ্রামের আজগর আলীর ছেলে আজাদ হোসেন, চ-ীপুর গ্রামের আমির খান, আব্দুল লতিফের ছেলে হাচেন আলী নিখোঁজ হয়। এসময় সৌভাগ্যক্রমে অন্যরা ট্রলারের বিভিন্ন ভাসমান বস্তু ধরে ভেসে থেকে বেঁচে যায়। নিখোঁজের ঘটনা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর জানার পর তৎকালীন ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান নিখোঁজদের বাড়িতে গিয়ে চাল ও ডাল সহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেন। এ সময় তিনি সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার ব্যাপারে পরিবারগুলোকে আশ্বস্ত করেন। পরে পুলিশ, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড, বিআইডাব্লিউটিএ ও ফায়ার সার্ভিস মেঘনায় দুই দিন ধরে খোঁজাখুঁজি করে কোনো লাশ উদ্ধার করতে পারেনি। উদ্ধার অভিযান শেষের পরের দিন মেঘনা নদীর ঘটনাস্থলের আশপাশে থেকে দু’টি লাশ উদ্ধার হয়। এরমধ্যে ভাঙ্গুড়া উপজেলার মু-মালা গ্রামের রফিকুল ইসলামের লাশ ছিল। তখন লাশ দাফন করার জন্য ওই পরিবারকে পাবনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ২০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়। কিন্তু অন্য পরিবারগুলো সরকারিভাবে কোনো আর্থিক সহযোগিতা পায়নি।
এরপর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুর রহমান নিখোঁজ পরিবারগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা দিতে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করেন। এতে ঘটনার তিনমাস পর পাবনা জেলা পরিষদ থেকে নিখোঁজ প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়। এরপর অন্য কোনো দপ্তর থেকে আর কোনো অনুদান পায়নি পরিবারগুলো।
দুই সন্তান ও জামাইকে হারানো জব্বার ফকির বলেন, ‘আমাদের ভাত কাপড় দেওয়ার আর কেউ নাই। ছেলে দুইটা কাম কাজ কইরা আমাগরে খাওয়াইতো। তারা মরনের পর থেকে আর কেউ আমাগরে খবর নেয় না। ছোট্ট একটা ছেলে আছে। তারেও ঠিকমতো খাবার-দাবার কাপড়-চোপড় দিতে পারিনা। সরকারও আমাদের দিকে তাকাইলো না। ছেলে মরনের পরে শরীর একবারে ভাইঙ্গা গেছে। কাজ করতে পারিনা। এখন এর ওর কাছ থেকে চাইয়া চিন্তা সংসার চালাই। সরকার আমাগোরে না দেখলে আমরা বাঁচবো ক্যামনে।’
ছেলে মানিককে হারানো পিতা নূর ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলে দুইটা ছোট বাচ্চা ও বউ রাইখা কামে গেছিল। ট্রলার ডুবিতে সব শেষ হইয়া গেল। ছেলে আর ফিরে আইলো না। অভাবে পইরা বৌমাটা আর বাড়ি থাকলো না। বাবার বাড়ি চলে গেছে। শুনেছি অন্যজনের সাথে নাকি বিয়াও হইয়া গেছে। সব হারানোর কষ্ট আর অভাবে বাইচা থাকতে ইচ্ছা করে না। সরকার যদি আমাগো একটু দেখতো।’
স্বামীকে হারানো রতœা খাতুন বলেন, ‘ছোট্ট দুইটা মাইয়ারে রাইখা স্বামী মারা গেল। এখন মানুষের বাড়ি কাম কইরা খাই। স্বামী মরার সময় কেউ খোঁজ খবর নিলেও এখন আর কেউ খোঁজ খবর নেয় না। মাইয়াগরে লইয়া খাইয়া না খাইয়া দিন যায়। শুনছিলাম সরকার নাকি আমাগরে টাহা দিব। এজন্য ফটো উঠছিলাম। কিন্তু ১০ হাজার টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা পাইলাম না।’
খানমরিচ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আসাদুর রহমান বলেন, ‘নিখোঁজ ব্যক্তিরা প্রতিটি পরিবারেই উপার্জনের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি ছিল। তারা মারা যাওয়ার পর প্রতিটি পরিবারই পথে বসে গেছে। অভাব-অনটনে ধুঁকে ধুঁকে চলছে পরিবারগুলো। তাই পরিবারগুলোকে কোনরকমে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারিভাবে কিছুটা আর্থিক সহযোগিতা পাইয়ে দিতে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়ঝাঁঁপ করেছি। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় খুবই হতাশ হয়েছি।’
এব্যাপারে ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলো সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার কথা। কিন্তু এক বছরেও সেটা না পাওয়া দুঃখজনক। দুর্ঘটনার সময় আমি এই উপজেলায় ছিলাম না। তাই বিষয়টা বিস্তারিত জেনে পরিবারগুলোকে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা দিতে পদক্ষেপ নেব।’