সরকারের বিভিন্ন কৌশলে ভুল আছে স্বীকার করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভুল-ভ্রান্তি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। শনিবার (৪ জানুয়ারি) রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির (জেপি) ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের ভুল আছে। আমরা অভ্রান্ত, এটা আমি দাবি করবো না। চলার পথে কৌশলের ভুল আছে, আমাদের কর্মেও ভুল আছে। আমরা অভ্রান্ত নই। অভ্রান্ত দাবি করা সঠিক নয়। ভুল-ত্রুটি মিলিয়ে আমরা বাংলাদেশেকে আজকে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা কোথায় নিয়ে গেছেন। আজকে আইএমএফ সর্বশেষ বলছে, আজকে বাংলাদেশ এশিয়ায় প্রবৃদ্ধিতে নাম্বার ওয়ান।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরস্পরের প্রতি যে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব রয়েছে, সেজন্য বিএনপিকে দায়ী করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর বিভিন্ন সময়ে আঘাত আসার পরও রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে বারবার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বিএনপির অসহযোগিতার কারণে সেই সম্পর্ক আরো খারাপ হয়েছে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, আজকে সামাজিক অনুষ্ঠানে কে কী মনে করে, কারো মৃত্যুর পর জানাজায় যাব কি না; এই দ্বিধাও আমাদের মাথায় কাজ করে। এসব বিষয় রাজনীতির জন্য শুভ নয়। এই কনফ্রন্টেশনাল পলিটিক্স গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। গণতন্ত্র এক চাকার বাইসাইকেল নয়, গণতন্ত্র দুই চাকার বাইসাইকেল।
তিনি বলেন, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে- সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলও গণতন্ত্রের বিকাশে অপরিহার্য শক্তি। বিরোধী দলকে অব্যশই গুরুত্ব দিতে হবে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে বিরোধী দলকেও শক্তিশালী করতে হবে। শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া শক্তিশালী গণতন্ত্র কল্পনাও করা যায় না। এটা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। যা আমরা বিশ্বাস করি, তা পালন করি না। এটাও বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক বাস্তবতা।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর খারাপ সম্পর্কের চিত্র তুলে ধরে ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজকে একটা অলঙ্ঘনীয় দেয়াল উঁচু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দেয়াল আমাদের কর্ম সম্পর্কের পথে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দেয়ালের সৃষ্টি হয়েছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যারা ছিল, তাদের সেই ভূমিকাকে বাদ দিয়ে ইতিহাস লেখার উপায় নেই।
ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন তোলেন, সেদিন কারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করেছিল? নিরাপদে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেল? বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল? কারা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিল? কারা পঞ্চদশ সংশোধনীতে এই ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্সকে সংযুক্ত করে আইনে পরিণত করেছিল, যাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যার খুনিদের বিচার না হয়? ইতিহাস তাদের ভুলে যাবে না।
তিনি বলেন, সম্পর্কের এই অলঙ্ঘনীয় দেয়াল সেখান থেকেই উঁচু হয়েছে। সেই দেয়াল উঁচু হতে হতে আরো উঁচু হয়েছে। ২১ শে আগস্ট প্রাইম টার্গেট শেখ হাসিনা। তাকে প্রাইম টার্গেট করে যে গ্রেনেড হামলা পরিচালনা করা হয়েছিল, সেই ইতিহাস বেশিদিন আগের নয়। কারা তখন ক্ষমতায়, কারা প্ল্যানার, কারা মাস্টারমাইন্ড- সবাই জানে। ইতিহাসের এই নির্মম অসত্য অস্বীকার করা উপায় নেই।
তিনি আরও বলেন, তারপরও এই অলঙ্ঘনীয় দেয়াল কীভাবে ভাঙব? আমাদের চেষ্টার কমতি ছিল না। এত কিছুর পরও বেগম জিয়ার সন্তানের মৃত্যুর পর শেখ হাসিনা তার বাড়িতে ছুটে গিড়য়েছিলেন সন্তানহারা মাকে সান্ত্বনা দিতে। ঘরের দরজা, বাইরের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনার মুখের পর এই অলঙ্ঘনীয় দেয়াল আরো উঁচুতে উঠল। সেদিন যদি শেখ হাসিনা শোকাতুর মাকে সান্ত্বনা দিতে সেই গৃহে প্রবেশ করতে পারতেন, রাজনীতিতে কর্ম সম্পর্কের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হতে পারত।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ২০১৪ সালের আগে এত কিছুর পরও শেখ হাসিনা গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বেগম জিয়াকে। তিনি ঘৃণাভরে গালাগাল করে যে ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন, আপনারা কি তা শোনেন নি? টেলিফোনের আলাপে এত অশ্রাব্য ভাষা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি উচ্চারণ … কী করে এখানে কর্ম সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কীভাবে আমরা বিএনপির সঙ্গে সহাবস্থান করব? কী করে সম্ভব? তারা ১৫ আগস্টের হত্যার নেপথ্যে ছিল, তারা ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মানস্টারমাইন্ড ছিল। এই অবস্থা হলো বাস্তবতা।
তিনি বলেন, তারপরও গত নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে বিএনপিসহ তাদের অনেককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সংলাপের ডাক দিয়েছিলেন।
রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার চক্রান্ত চলছে, অভিযোগ করে ১৪ দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ আছে। রক্তের গন্ধ আছে। আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমরা একসঙ্গে কাজ করব। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
১৯৯৬ সালে সরকার গঠনে আওয়ামী লীগের পাশে থেকে সহযোগিতা করার জন্য জেপি ও এর চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান ওবায়দুল কাদের। এ সময় তার বাবা প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ারও স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম বিএনপির উদ্দেশে বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে বিতর্কিত করবেন না। নির্বাচনের মাঝপথে পালিয়ে যাবেন না। ফলাফল ঘোষণা না পর্যন্ত নির্বাচনে মাঠে থাকবেন।
জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সভাপতিত্বে এতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।