বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্র্তৃপক্ষের আন্তঃদাপ্তরিক সমন্বয়ের অভাবে কোন কাজেই লাগছে না ইন-সার্ভিস ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জনকারী ২২’শ স্যানিটারী ইন্সপেক্টর। দেশের জনগণের খাদ্য-স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও খাদ্য মাধ্যমে সৃষ্ট দু’শতাধিক রোগ-নিয়ন্ত্রণে সুফল পাবার লক্ষ্যে গড়ে তোলা এ দক্ষ-জনবলের পেছনে সরকারের বিপুল অংকের বিনিয়োগ এতে করে ভেস্তে যেতে বসেছে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নত দেশের ধ্যাণ-ধারণায় খাদ্য-স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, খাদ্যভেজাল নিয়ন্ত্রণ, নগরের বর্জ্য অপসারন ও নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনার উপর তিন বছরের স্যানিটারী ইন্সপেক্টরশীপ ডিপ্লোমা কোর্সে প্রশিক্ষিত করা হয় ২২’শ স্বাস্থ্য সহকারী। এই ডিপ্লোমাধারী জনবল তৈরীতে সরকার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে কাজের ক্ষেত্র তৈরী না-করায় বাস্তবে এ জনবল জনগণের কোন কাজেই লাগছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে ২৫ লাখের বেশী ব্যবসায়িক খাদ্যস্থাপনা রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সংখ্যক স্যানিটারী ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক না-থাকায় এগুলোকে নিবন্ধন ও নিরন্তর তদারকীর অধীনে নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। ভেজালের সম্প্রসারণ ও ভেজালকারীর দৌরাত্ব্য বেড়েই চলেছে। বাড়ছে খাদ্য-সংশ্লিষ্ট রোগীর সংখ্যাও। রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ সূত্র বলেছে, সরকারের হাতে নিবন্ধিত ও সনদপ্রাপ্ত স্যানিটারী ইন্সপেক্টরশীপ ২২’শ হলেও স্বাস্থ্য অধীদপ্তরের অধীনে স্যানিটারী ইন্সপেক্টরের পদ রয়েছে ৫৫৬ জনের। কর্তৃপক্ষ ১৯৭৩ সালের বঙ্গবন্ধু সরকার আমলের এই জনবল কাঠামো দিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দেখভাল করাচ্ছেন সরকারী-স্বায়ত্বশাসিত-বেসরকারী জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন খাদ্যস্থাপনা সমূহ। জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন কাজের সাথে ওয়াকেবহাল সূত্র সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের সকল বাণিজ্যিক খাদ্যস্থাপনার উৎপদান-মজুদ ও বিপনন ব্যবস্থা, সরকারী-বেসরকারী জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং ভেজালের ধরণ-ধারণ বিবেচনায় নিলে ৬ হাজারের বেশী স্যানিটারী ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক একসাথে কাজে নামানোর প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলো, খাদ্যভেজাল নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে বা জরুরী প্রয়োজনেও সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের হাতে মজুদ থাকা ২২’শ জনবল কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ-দ্বয়। তদুপরি গত নভেম্বর মাসে নানা অসঙ্গতিসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে স্যানিটারী ইন্সপেক্টরশীপ ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারীদের জন্য আবারও নতুন করে বিএসসি ইন হেলথ টেকনোলজি (ফুড সেফটি) ইন-সার্ভিস কোর্স চালুর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। অনেকে মনে করছেন, এমন অপ-পরিকল্পনার ভিত্তিতে দক্ষ-জনবল তৈরীর খাতে সরকারের ব্যয় বাড়ানো হলেও দ্রæততর সময়ে এই জনবল জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন তথা খাদ্যভেজাল নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগানোর কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, বিগত ৪৬ বছর যাবৎ বর্ধিত জনসংখ্যা, খাদ্যস্থাপনা ও বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক কাঠামোর আনুপাতিক হারে স্যানিটারী ইন্সপেক্টরের পদের সংখ্যা বাড়ানো না-হলেও স্যানিটারী ইন্সপেক্টর তৈরী করার প্রক্রিয়াটি অব্যাহত আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত ৭-টি ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি)’তে স্যানিটারী ইন্সপেক্টরশীপ কোর্স চালু রাখার বিপরীতে প্রতি বছর সরকারের শত শত কোটি টাকার রাজস্ব-ব্যয়-বিনিয়োগ করা হলেও ইহার ফিড-ব্যাক শূন্য। নিরাপদ খাদ্য আইন- ২০১৩ সর্বাত্মক কার্যকর করার নিমিত্তে বিগত ২০১৭ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মহাপরিচালক-১ কে প্রধান করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান কাজ-ই ছিল বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অধীনে মাঠ-পর্যায়ে কাজের মৌলিক জনবল কাঠামো (পরিদর্শক) নির্ধারণ করাসহ অন্যান্য ঘাটতি চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণ। কিন্তু স্বাস্থ্য ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের অভাবে উক্ত কমিটিতে উল্লেখিত ২২’শ জনবল কাজে লাগানোর বিষয়ে কোন পরিকল্পনা ও আলোচনার কথা শুনা যায়নি। নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার পরিদর্শন কাজের জনবল ঘাটতি কাটিয়ে উঠার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার ওয়ায়েছ আল হারুনী ও ব্যারিষ্টার ফয়েজ উদ্দিন আহমদ বলেন, উভয় কর্তৃপক্ষ (স্বাস্থ্য ও নিখাপ) সম্মত হলে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১, ৪০ ধারা অনুসরন করে নিরাপদ খাদ্য আইনের ১৯, ৫১, ৮২, ৯০ ধারা সমূহকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য বিধি- ১৯৬৭’র আলোকে বিদ্যমান আইন-বিধির পরিবর্তন না-করেই এই দক্ষ-জনবল কাজে লাগানো যাবে। এতে আইনত কোন বাধা নেই। বরং একই উদ্দেশ্যে পূর্ববর্তী আইন-বিধি দ্বারা সৃষ্ট-দক্ষ রাষ্ট্রীয় জনবল কাজে না-লাগানোর কলাকৌশল বা দীর্ঘসূত্রীতার অবলম্বন কার্যতঃ আইনের প্রয়োগ ও জনকল্যাণ বাধাগ্রস্থ করছে। আমাদের দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় এটার কারণ দু’টি – প্রথমত: হতে পারে ব্যবস্থাপকদের দক্ষতার অভাব, দ্বিতীয়ত: দেখতে হবে খাদ্যভেজাল নিয়ন্ত্রণ বিলম্বিত হলে এর লাভ-ভোগী কারা? তাদের কোন অনৈতিক প্রভাব ব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির উপর রয়েছে কি না? প্রশাসনের উচিত হবে খাদ্যভেজাল নিয়ন্ত্রণের মত জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অতি-অল্প সময়ে নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকদের কর্মএলাকা বিভাজন করে পর্যাপ্ত সংখ্যক জনবল জরুরী ভিত্তিতে প্রেষণে পদায়ন করা। পরে পর্যায়ক্রমে পদ সৃজন করে এদেরকে নিয়মিত করা যাবে। যেমনটা করা হয়েছিল এডহক চিকিৎসক নিয়োগের ক্ষেত্রে। এই প্রতিবেদকের মাঠ-পর্যায়ের অনুসন্ধানে আরও চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালের ২’রা ফেব্রæয়ারী থেকে ভেজাল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে গেলেও কর্তৃপক্ষের জনবল কাঠামোতে আইনে উল্লেখিত নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক নামীয় মৌলিক জনবলের প্রয়োজনীয়/জরুরী চাহিদা নির্ধারণে চরম উদাসীন। স্বাস্থ্য দপ্তরে ৬৪ জন জেলা স্যানিটারী ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক পদ থাকা সত্তেও কর্তৃপক্ষ আরও ৬৪ জন জেলা নিরাপদ খাদ্য অফিসার-সহ অন্যান্য ক্যাটাগরীতে ইতিমধ্যে ৩৭৪ জন জনবলের পদ-সৃজন করেছেন। কিস্তু এইদিকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয়ের মত জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের খাদ্যস্থাপনা, বাংলাদেশ হাইকোর্টের খাদ্যস্থাপনা, কয়েকটি সিটিকর্পোরেশন, অনেকগুলো পৌরসভা, ২৫-টি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ও অন্যান্য অনেক সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাঠামোর আওতাধীন খাদ্যস্থাপনার নিয়মিত পরিদর্শন করার জন্য এখন পর্যন্ত কোন স্যানিটারী ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের পদায়ন করা হয়নি। ১৯৭৩ সালের জনবল কাঠামোতে যে সকল স্যানিটারী ইন্সপেক্টর নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের দায়িত্বপালন করছেন তাঁদের সংখ্যা এতই অপ্রতুল যে, কর্মএলাকার সকল খাদ্যস্থাপনা নিয়মিত তদারকি ত দূরের কথা, পূর্ণ আন্তরিকতা থাকা সত্তেও কোন-একটি খাদ্যস্থাপনা পুনরায় পরিদর্শনে যেতে দুই থেকে তিন মাস দেরী হয়ে যায়। খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধে নিরন্তর তদারকির জন্য মৌলিক জনবল অর্থাৎ পরিদর্শক সংখ্যা না-বাড়িয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ঢাকা শহর কেন্দ্রিক মোবাইল-কোর্ট, ভ্রাম্যমান নিরাপদ খাদ্য পরীক্ষাগার ও অন্যান্য যে কোন ধরণের গৃহিত কার্যক্রমে পরিস্থিতির আশু উন্নতি ও স্থায়ী সমাধান হবে বলে মনে করেন না জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ- ১৯৫৯ রহিত করে নিরাপদ খাদ্য আইন- ২০১৩ প্রণয়নের কারণে উদ্ভূত আমলাতান্ত্রিক জঠিলতা হেতু, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিগত ৬/৭ বছর ধরে পদ, পদোন্নতি ও পদায়ন বঞ্চিত স্যানিটারী ইন্সপেক্টরশীপ ডিগ্রী অর্জকারীরা হতাশার সাগরে নিমজ্জিত রয়েছেন, কেউ কেউ পদোন্নতি বঞ্চিত অবস্থায় মারা গেছেন এবং তাঁদের অনেকে চাকুরী থেকে ইস্তফা দেয়ারও চিন্তা ভাবনা করছেন।