সুরমা নদীর ভাঙ্গনে সিলেটের বিশ্বনাথে বেড়েই চলছে মানুষের দূর্ভোগ। অবৈধভাবে ইজারা বিহীন অংশে বালু ও মাটি উত্তোলনের ফলে সুরমা নদীর ভাঙ্গনের তান্ডব দিনে দিনে প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ওই তান্ডবে ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এলাকার মসজিদ, কবরস্থান, বাজার, সড়কের বিশাল অংশ, ফসল জমিসহ ঘর-বাড়ি। এছাড়াও বিলীন হওয়ার দাঁড়প্রান্তে রয়েছে একাধিক স্কুল-কলেজ, ইউনিয়ন পরিষদের ভবন, মাজার, বাজার, ঘর-বাড়ি, কৃষি জমিসহ একাধিক সড়ক।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৪২৬ বাংলা সনে ১৬ লাখ টাকায় মশউদ আহমদের লাইসেন্সে ‘তিলকপুর-শিবেরখলা বালুমহাল’ এক বছরের জন্য ইজারা প্রদান করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক। আর সিলেট সদর উপজেলার সার্বেয়ার ইজারাদেরকে বালু ও মাটি উত্তোলনের জন্য ইজারার নির্দিস্ট সীমানা ও দাগ দেখিয়ে দিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্থদের অভিযোগ, প্রত্যেহ গভীর রাতে ১৫/২০টি নৌকায় নিয়ে এসে ইজারাদাররা প্রতি বছরই তাদের ইজারাকৃত সিলেট সদর উপজেলা শিবেরখলা মৌজার (জেএল নং ৪১) মৌজার পরিবর্তে বিশ্বনাথ উপজেলার গৌরী শংকর (জেএল নং ৮), হাজরাই (জেএল নং ১৯), আমিরুল্লাহাজ মৌজায় (জেএল নং ২০) এসে অবৈধভাবে বালু-মাটি উত্তোলন করছে। এর ফলে ব্যাপকহারে ভাঙ্গছে বিশ্বনাথ উপজেলার বিভিন্ন মৌজার অংশ ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন জনসাধারণ। তাই নদী ভাঙ্গন রোধ করতে সদরের ‘শিবেরখলা মৌজা’ ও বিশ্বনাথের ‘আমিরুল্লাহাজ-গৌরী শংকর-হাজরাই মৌজার’ সীমানা দ্রুত নির্ধারণ করার জন্য প্রশাসনসহ সরকারের কাছে জোর দাবী এলাকাবাসীর। এদিকে সদর উপজেলার পরিবর্তে বালু-মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে বিশ্বনাথ উপজেলার সীমানায়, আর রাজস্ব পাচ্ছে শুধু মাত্র সদর উপজেলা। ফলে নদী ভাঙ্গনে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় পরও প্রাপ্য রাজস্বও হারাচ্ছে বিশ্বনাথ উপজেলা।সুরমার ভাঙ্গন তান্ডব রোধ করার জন্য কার্যকর প্রদক্ষেপ গ্রহনের পাশাপাশি ভাঙ্গন চলমান এলাকা থেকে বালু-মাটি উত্তোলন প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য এলাকাবাসী প্রশাসনসহ সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে আসলেও তা হচ্ছে না। ফলে মাত্র ১৬ লাখ টাকার ইজারার জন্য ভাঙ্গন রোধ করে সড়কসহ নদীর তীরের সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, সড়ক, কবরস্থান-মাজার, বাড়ি-ঘর-ফসলী জমি রক্ষার জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধিনে সরকারকে দুই দাফে বরাদ্ধ দিতে হয়েছে প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা (১ম দাফে প্রায় ১৩ কোটি ও ২য় দাফে প্রায় ১২০ কোটি ৮২ লাখ টাকা)। অথচ এলাকাবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে ২/৩ বছর পূর্বে ‘তিলকপুর-শিবেরখলা বালুমহালের’ ইজারা বাতিল করলে বর্তমান সময়ে এসে সরকারকে সুরমা নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে এতো টাকা বরাদ্ধ দিতে হতো না। বরং ওই টাকা দিয়ে উপজেলাবাসীর কল্যাণকর কোন প্রদক্ষেপ গ্রহন করা যেতো। এলাকাবাসীর অভিযোগ, শিবেরখলা মৌজার পরিবর্তে অবৈধভাবে আমিরুল্লাহাজ-গৌরী শংকর-হাজরাই মৌজায় এসে বালু-মাটি উত্তোলনে এলাকাবাসী বাঁধা-নিষেধ করলে ইজারাদাররা এলাকার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে জেলার বিভিন্ন থানায় চাঁদাবাজি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দায়ের করার হুমকি-ধামকি প্রদান করেন। এমনকি ইতিপূর্বে অনেককেই এধরণের মিথ্যা মামলায় আসামীও হতে হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আর দীর্ঘদিন ধরে ইজারাদারকে এসব ব্যাপারে প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী সহযোগীতা করে থাকেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।সরেজমিনে এলাকা ঘুরে জানা গেছে, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু-মাটি উত্তোলন করে লামাকাজী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় স্টক করে বিক্রি করার সাথে জড়িত আছেন বিশ্বনাথ উপজেলার সাঙ্গিরাই গ্রামের রফিকুল ইসলাম, হাজরাই গ্রামের বাবুল মিয়া, দিঘলী গ্রামের কয়েছ মিয়া, জাগিরালা গ্রামের জহির উদ্দিন, সদর উপজেলার আলীনগর গ্রামের কয়েছ মিয়া। তাদের মধ্যে সাঙ্গিরাই গ্রামের বাসিন্দা ও লামাকাজী ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলামের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু-মাটি উত্তোলনের বিরুদ্ধে কথা বললে বা বাঁধা দিলে তার (রফিকুল) ভয়ে এলাকাবাসীকে আতংকের মধ্যে থাকতে হয় বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তাছাড়া বিশ্বনাথের বিভিন্ন অংশ বালু-মাটি উত্তোলনের ফলে ভাঙ্গতে থাকলেও, উত্তোলিত ওই মাটি দিয়েই রফিক টুকেরবাজারস্থ ‘কল্যাণ সিটি’ নামক একটি হাউজিং কোম্পানীর বিশাল জায়গা ভরাট করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।উপজেলার আকিলপুর গ্রামের ইমন আহমদ বিজয়, সালা উদ্দিন, চয়ন আচার্য্য বলেন, সরকার একদিকে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে কোটি-কোটি টাকা বরাদ্ধ দিচ্ছেন, আর অন্যদিকে বালুমহাল ইজারা দিয়ে পাচ্ছেন মাত্র ১৬ লাখ টাকা। এতে করে সার্বিক ভাবে আমরাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি, পাশাপাশি অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা। অথচ ওই ইজারা বাতিল করে দিলেই বরং নদীর ভাঙ্গন রোধ হতো, পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকাও সাশ্রয় হতো। নদী ভাঙ্গনের ফলে প্রায় ২ মাস পরগণা বাজার-আকিলপুর সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। আর নদী ভাঙ্গন বন্ধ হলে রক্ষা পাবে আমাদের মসজিদ-মাজার, কবরস্থান, বাজার, রাস্তাঘাট, কৃষিজমি, বাড়ি-ঘর। উপজেলার রাজাপুর গ্রামের নুরুল হক, হাজরাই গ্রামের আশরাফ আলী, ছাদ উদ্দিন, পরগণা বাজারের সিতারা বেগম বলেন, ইজারা অনুযায়ী শিবেরখলা মৌজা থেকে বালু-মাটি উত্তোলনের কথা থাকলে ইজারাদার গভীর রাত থেকে ১৫/২০টি নৌকা নিয়ে এসে আমিরুল্লাহাজ-গৌরী শংকর-হাজরাই মৌজার অংশে বালু-মাটি উত্তোলন করেন। আমিরুল্লাহাজ-গৌরী শংকর-হাজরাই ও শিবেরখলা মৌজার সীমানা নির্ধারণ করা হলেই আমাদের সম্পদ নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পাবে। তাছাড়া ইজারাবিহীন অংশে অবৈধভাবে বালু-মাটি উত্তোলনে বাঁধা দিলে এলাকাবাসীকে মিথ্যা চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের মামলা করার হুমকি দেয় ইজারাদাররা। ফলে ইজারার অংশ (শিবেরখলা মৌজা) ভালো থাকলেও আমিরুল্লাহাজ-গৌরী শংকর-হাজরাই মৌজার অংশে থাকা জনসাধারণের বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, মাজার-কবর, কৃষি জমি ভেঙ্গে নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে, এছাড়া হুমকির মুখে রয়েছে একাধিক স্কুল-কলেজ-বাজার, ইউনিয়ন পরিষদের ভবন, বিশ্বনাথ-রামপাশা-লামাকাজী ও লামাকাজী-পরগণাবাজার-আকিলপুর সড়ক।উপজেলার আকিলপুর গ্রামের এলাইছ মিয়া, রাজাপুর গ্রামের আবদুল লতিফ, সত্তোরর্ধ্ব আলহাজ্ব সজ্জাদ চৌধুরী লিলু বলেন, নদীর বর্তমান অবস্থান আমাদের পূর্বপুরুষদের পৈত্রিক সম্পত্তির উপর রয়েছে। নদী ভাঙ্গনের ফলে তা আজ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আর আমাদের ভূমিটুকু পড়েছে আমিরুল্লাহাজ মৌজায়। নদীর উত্তর পাড়েও আমিরুল্লাহাজ মৌজার বিশাল এরিয়া রয়েছে। সীমানা নিধারণ করা হলে তা বেরিয়ে আসবে। তাই শিবেরখলা মৌজার ইজারার কথা বলে যেখানে বালু-মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে তা প্রকৃত পক্ষে আমিরুল্লাহাজ-হাজরাই-গৌরী শংকর মৌজার জায়গা। নদী ভাঙ্গন রোধ, আমাদের জায়গা-জমি ও মামলার হুমকি-ধামকি থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষা করার জন্য দ্রুতই আমিরুল্লাহাজ-হাজরাই-গৌরী শংকর মৌজা ও শিবেরখলা মৌজার সীমানা নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবী। এজন্য প্রশাসনসহ সরকারের সু-দৃষ্টি কামনা করছি আমরা।বালু-মাটি ব্যবসায়ী হাজরাই গ্রামের বাবুল মিয়া বলেন, আমি ছাতকের গোবিন্দনগর গ্রামের আবদুস ছত্তার, সদরের লালারগাঁও সাহাব উদ্দিন ও সুহেল আহমদের কাজ থেকে ফুট হিসেবে বালু ও মাটি ক্রয় করে স্টক করে বিক্রি করি। আমার কাছে ক্রয়ের রিসিটও আছে। এব্যাপারে সদর উপজেলার লালারগাঁও সাহাব উদ্দিন বলেন, আমি ইজারাদার সুবিদ বাজারের নাসিম আহমদ ও সাঙ্গিরাই গ্রামের রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে ফুট হিসেবে বালু-মাটি ক্রয় করি এবং নদী থেকে উত্তোলন করে তা আবার অন্যদের কাছে বিক্রি করি।প্রভাব কাটানো বা কাউকে হুমকি দেওয়া বা কারও বিরুদ্ধে মামলা করার অভিযোগ মিথ্যা দাবী করে করে বালু-মাটি ব্যবসায়ী সাঙ্গিরাই গ্রামের বাসিন্দা ও লামাকাজী ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, মশউদ আহমদের লাইসেন্সের নামে তিলকপুর-শিবেরখলা বালুমহাল ইজারা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। আর লাইসেন্স একজনের নামে থাকলেও ব্যবসার সাথে আমরা কয়েকজন জড়িত আছি। সে হিসেবে নদীর ইজারাকৃত অংশ থেকে বালু-মাটি উত্তোলন করে বিক্রি করছি।গভীর রাতে বালু-মাটি উত্তোলন ও এলাকাবাসীকে হুমকি-ধামকি প্রদানের অভিযোগ মিথ্যা দাবী করে ইজারার সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক অ্যাডভোকেট নাসিম আহমদ বলেন, আমার বড় ভাইয়ের (মশউদ আহমদ) লাইসেন্সে ১ বছরের জন্য ‘তিলকপুর-শিবেরখলা মৌজার’ বালুমহাল ইজারা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। আর প্রশাসনের দেখানো সীমানার মধ্যে থেকেই আমরা বালু-মাটি উত্তোলন করি ফজরের পর থেকে দিনের বেলা পর্যন্ত। রাতে কেউ বালু-মাটি উত্তোলন করলে, আর বিষয়টি আমাদেরকে জানালে প্রশাসনের পাশাপাশি আমরাও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমিরুল্লাহাজ মৌজার নামটি আজই (শনিবার) আমি প্রথম জানলাম। লামাকাজী ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার মোঃ নুরুজ্জামান বলেন, নদী ভাঙ্গনের ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বিশ্বনাথবাসী। ভাঙ্গনের ফলে সুরমা নদী নিজের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আমিরুল্লাহাজ-হাজরাই-গৌরী শকর মৌজায় অবস্থান করছে। নদীর ওপারে ভরাট হওয়া অংশে ওই মৌজাগুলোর বিশাল এরিয়া রয়েছে। কিন্তু নদী আমাদের অংশের দিকে সরে আসার কারণে ওপাড়ের অংশে থাকা আমাদের ভূমি সীমানা নিধারণ না করা পর্যন্ত দাবী করা যাচ্ছে না। তাই বিশ্বনাথের আমিরুল্লাহাজ-হাজরাই-গৌরী শকর মৌজা ও সদরের শিবেরখলা মৌজার সঠিক সীমানা নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবী। বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বর্ণালী পাল বলেন, দ্রুত কার্যকর প্রদক্ষেপ গ্রহনের জন্য উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে।সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মহুয়া মমতাজ বলেন, সার্বেয়ার পাঠিয়ে ইজারাদারদেরকে বালু-মাটি উত্তোলনের জন্য ইজারাকৃত অংশের সীমানা ও দাগ দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে গিয়ে বালু-মাটি উত্তোলনের অভিযোগে পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। আর মৌজার সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি জটিল, তাই এব্যাপারে জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করতে হবে।এব্যাপারে সিলেটের সহকারী জেলা প্রশাসক (রেভিনিং) মোহাম্মদ নাসির উল্লাহ খান বলেন, ইজারা নির্দিস্ট সীমানার বাইরে গিয়ে বালু-মাটি উত্তোলন করার অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। মৌজাগুলোর সীমানা নির্ধারণ করতে চাইলে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদন করতে হবে।