মুক্তিযুদ্ধের বিজয় স্তম্ভ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণের দাবীতে আটঘরিয়াবাসী এখন সোচ্চার

–এবাদত আলী
পাবনা জেলার একটি উল্লেখযোগ্য উপজেলা হলো আটঘরিয়া। পাবনা জেলা শহর থেকে এর দুরত্ব মাত্র ১৩ কিলোমিটার। আটঘরিয়া একটি অতি পুরাতন থানা। ভারত স¤্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে (খ্রিস্টপুর্ব ৩২৪-৩০০ অব্দে) বঙ্গ বিভাগ নামে যে এলাকা ছিলো, পাবনা ছিলো তার অন্তর্ভুক্ত। ঐসময় এ অঞ্চলে পোদ জাতির বসবাস ছিলো। এই পোদ জাতির আটঘর মানুষ এখানে বসতি স্থাপন করে। ফলে এলাকাটির নামকরণ হয় আটঘরিয়া।
কেউ কেউ বলেন, ১৮৫৭ খিস্ট্রব্দে সিপাহী বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহের অপরাধে আটজন সিপাহীকে নদী- অরণ্য বেষ্টিত, সাপ, মশা-মাছির অভয়ারণ্য, এই ্দ্বীপ এলাকার জঙ্গলে নির্বাসনে দেওয়া হয়। নির্বাসিত সেই সিপাহীরা বুদ্ধি খাটিয়ে এ অঞ্চলে নিজেদের বসতের উপযোগি করে তোলে। নির্বাসিত সিপাহীরা প্রথমে আটটি ঘর বা বসতবাড়ি নির্মাণ করে এ এলাকায় বসবাস শুরু করায় স্থানটির নাম হয় আটঘরিয়া।
ঐতিহাসিক সুত্রে জানা যায়- অতীতে পাবনা জেলায় চোর-ডাকাতের চরম উৎপাত ছিলো। বিশেষ করে বৃহৎ চলনবিল অঞ্চলের ডাকাতদল রতœাই ও চন্দ্রবতী নদী হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে অবাধে চলাফেরা করতো এবং প্রায়ই ডাকাতিতে লিপ্ত হতো। এলাকার জান-মাল রক্ষার্থে প্রথমে আটঘরিয়াতে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে আটঘরিয়ার মৃত লালন সিংহের স্ত্রী মাতঙ্গিনী সিংহ ১১ বিঘা জমি দান করেন। উক্ত জমির উপর ১৯১৫ সালের ১৩জানুয়ারি আটঘরিয়া থানা (পুলিশ স্টেশন) ভবন নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮৩ সালে আটঘরিয়া থানা উপজেলায় রূপান্তর হয় এবং এর সদর দপ্তর হয় দেবোত্তরে।
প্রায় ২লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষ্যিত এই আটঘরিয়ার মানুষ ১৯৭১ সালে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল মানুষই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। তাই মুক্তিবাহিনীর ভুমিকা ছিলো গৌরবোজ্জল। আটঘরিয়ায় তখন ছাত্র-জনতা এক কাতারে শামিল হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সর্ব প্রথম যুদ্ধে লিপ্ত হন আটঘরিয়া থানার এ এস আই আব্দুল জলিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের সুচনা লগ্নে অর্থাৎ ২৯ মার্চ, ১৯৭১ পাবনা সদরের মালিগাছা নামক স্থানে পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। যার সমাধি দেবোত্তর বাজার সংলগ্ন নবনির্মিত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের পাশেই অবস্থিত।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন উৎস্বর্গকারি পুলিশ অফিসার আব্দুল জলিলের নাম পাবনা পুলিশ লাইনস স্মৃতিস্তম্ভে ১ নং ক্রমিকে এবং ঢাকা পুলিশ হেডকোয়ার্টার স্মৃতিস্তম্ভে ৫ নং ক্রমিকে লিপিবদ্ধ রয়েছে। পাবনার ভূতপুর্ব পুলিশ সুপার জিহাদুল কবিরের প্রচেষ্টায় শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এস আই শহীদ আবদুল জলিলের নামে পাবনা পুলিশ লাইনস এর অডিটরিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু মালিগাছা রণাঙ্গনের স্মৃতিস্তম্ভের কাজ এখনো অসমাপ্তই রয়ে গেছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে আটঘরিয়া থানার পিস কমিটির দালাল মৌলভী আব্দুল লতিফ ওরফে লতিফ মওলানা, থানার রাজাকার কমান্ডার মোমিন, রাজাকার মজিবর রহমান ঠান্ডা, রশিদ, আবু তালেব রাজাকার প্রমুখ ব্যক্তি এবং গোড়রী- ফৈলজানার নাথু পাটনী আটঘরিয়া থানার গোড়রী গ্রামের হিন্দুদের উপর পাকিস্তানি আর্মিদের দ্বারা অকথ্য নির্যাতন চালায়। এই খবর পাবার পর ঈশ্বরদীর ওয়াছেফ কমান্ডারের নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাত ১০ টার সময় নাথু পাটনীর বাড়ি আক্রমণ করে। এতে বেশ কিছু রাজাকার হতাহত হয়। ২২ অক্টোবর বেরুয়ানে রাজাকারদের সাথে মুক্তি বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে হায়দার আলী ও তোয়াজ উদ্দিন মাষ্টার শহীদ হন। তাদের দুজনের কবর হাড়লপাড়া গ্রামে অবস্থিত।
নভেম্বর মাসের ৬ তারিখে খিদিরপুর বংশিপাড়া নদীর ঘাটে পাকিস্তানি আর্মিদের সাথে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে ১১জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হনএবং বহুসংখ্যক গ্রাম বাসি নিহত হয়। অপর পক্ষে আর্মি ক্যাপ্টেন তাহির খানসহ বহসংখ্যক আর্মি নিহত হয়। বাকিরা পালিয়ে জীবন রক্ষা করে। পাকিস্তানি সেনারা থানার রজাকারদের সহযোগিতায় আটঘরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল লক্ষীপুর, শ্রীপুর ও কৈজুড়ি গ্রামে হামলা চালায়। তারা লুট-তরাজ, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ ও গণহত্যায় লিপ্ত হয়। এদিন রাজশাহী বেতার শিল্পী এমএ গফুরসহ হিন্দু- মুসলমানদের ২৮ জনকে হত্যা করে ইছামতি নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়।
ডিসেম্বর মাসের ১১ তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা বেলদহের যুদ্ধে অংশগহণ করে এবং শাহজাহান আলী কমান্ডার ও অন্যন্য কমান্ডারের কমান্ডে মুক্তি বাহিনী ১৩ ডিসেম্বর আটঘরিয়া থানা আক্রমণ করে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আটঘরিয়া থানা হানাদার মুক্ত হয়। থানায় অবস্থানরত পুলিশ ও ম্যালেশিয়া বাহিনী জীবন বাাঁচাতে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়।
আটঘরিয়ার অভিরামপুরের মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান ফনি মিয়া থানার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাজাকার বাহিনী আত্মগোপনে চলে যায়। কেউ কেউ আবার জীবন বাঁচাতে নিজের শোবার ঘরে বিশাল গর্ত খুড়ে সেই গর্তের মধ্যে বসবাস করতে থাকে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে। বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নিজ থানায় ফিরে আসে। মুক্তিযোদ্ধা নামধারি কিছু দুষ্কৃতকারী আটঘরিয়া থানার বিভিন্ন এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে। তারা বেশ কজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। তবে রক্ষীবাহিনীর তৎপরতায় অবশেষে তা প্রশমিত হয়।
যাহোক মহান মুক্তিযুদ্ধে আটঘরিয়া থানার মুক্তিযোদ্ধাদের ভুমিকা ছিলো প্রশংসনীয়। পরবর্র্তীকালে আটঘরিয়াতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠিত হয়। এই সংসদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাগণ সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা লাভ করতে থাকে। বর্তমানে আটঘরিয়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১শ ৫৬ জন। মাসিক ভাতা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১শ ৩০ জন।
আটঘরিয়ার মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে খিদিরপুরের বংশিপাড়া ঘাটে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মিত হয়। সরকার তরফ হতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর পাকা করার ব্যবস্থা করা হয়। সর্বোপরি ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নব নির্মিত আটঘরিয়া মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়।
গত ২৮ জুন-২০১৯, প্রধান অতিথি হিসেবে কমপ্লেক্স ভবনের শুভ উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ,ক,ম, মোজাম্মেল হক। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক বাংলাদেশ টেলিভিশন মালিক সমিতির সভাপতি এবং মাছরাঙা টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জন চৌধুরি পিন্টু ও পাবনা পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম বিপিএম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পাবনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আটঘরিয়ার ভুমিকা প্রশংসনীয় হলেও মক্তিযুদ্ধের অমর স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে এ উপজেলা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।
২০০১ সালে দিকে আটঘরিয়ার তদানিন্তন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রফিক উদ্দিন আটঘরিয়া উপজেলা চত্তরের পশিচম-দক্ষিণ কোনে আটঘরিয়া প্রেসক্লাব সংলগ্ন পুকুর পাড়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় স্তম্ভ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০১ সালের আগষ্ট মাসের ১ তারিখে তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে সেখানে মাটি ভরাটের কাজও শুরু করেন। কিন্তু তিনি বদলি হয়ে যাবার পর সে কাজ আজো পর্যন্ত কোন কর্মকর্তার নজরে আসেনি বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। আজো উপজেলা নির্বাহী অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক উদ্দিন কর্তৃক স্থাপনকৃত মুক্তিযুদ্ধের বিজয় স্তম্ভটির ভিত্তিপ্রস্তর ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে দন্ডায়মান রয়েছে।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে সাড়া দিয়ে আটঘরিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ নিজেদের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আটঘরিয়া থানার এ এস আই শহীদ আব্দুল জলিলসহ অনেকেই শাহাদত বরণ করেছেন। সেই সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে স¦র্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকলেও আটঘরিয়ায় আজো কোন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কিংবা মুক্তিযুদ্ধের বিজয় স্তম্ভ নির্মিত হয়নি। এই দাবী বাস্তবায়নে তারা সকলেই এখন সোচ্চার।
তাই বর্তমানে জাতির পিতা বঙ্গব›দ্ধু শেখ মুজিবের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় আটঘরিয়াতে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় স্তম্ভ এবং একটি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর নির্মাণের জন্য আটঘরিয়াবাসি জোর দাবী জানিয়েছেন। (লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা,সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
বাসা: টেবুনিয়া, পাবনা।