বিশ্বনাথে ফরিদ পরিবারে শোকের মাতন, জানাযায় মানুষের ঢল, দাফন সম্পন্ন

মো. আবুল কাশেম, বিশ্বনাথ থেকে :: ইউক্রন থেকে ফ্রান্স যাওয়ার পথে স্লোভাকিয়ায় লাশ হয়ে দেশে ফিরলেন বিশ্বনাথের ফরিদ উদ্দিন আহমদ (৩৫)। তিনি বিশ্বনাথ উপজেলার কারিকোনা গ্রামের সমশাদ আলীর ছেলে। সেদেশে একমাস তাঁর লাশ থাকার পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে যুক্তরাজ্যে হিথ্রো বিমান বন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে সিলেট ওসমানী আন্তজার্তিক বিমানবন্দরে তাঁর লাশ এসে পৌছে। সেখানে তাঁর স্বজনরা লাশ গ্রহন করেন। কিন্তু কিভাবে সেদেশে তাঁর মৃত্যু হয়েছে তা জানাযায়নি। পরে দেশে আসা তাঁর লাশ বাড়িতে না এনে বিদেশে ফরিদের মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে পরিবারের সদস্যরা বিমানবন্দর থেকে লাশ ময়না তদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যাওয়া যান। ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে তাঁর মৃতদেহ সিলেট হীমঘরে রাখা হয়। শুক্রবার দুপুরে হীমঘর থেকে ফরিদের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
এদিকে, শুক্রবার বাদ জুম্মার ফরিদের জানাযার নামাজ স্থানীয় পশ্চিম কারিকোনা গ্রামের জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার নামাজে ইমামতি করেন মরহুমের চাচাত ভাই মাওলানা লুৎফুর রহমান।
বিশ্বনাথ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম জুবায়েরের পরিচালনা জানাযার নামাজের পূর্বে বক্তব্য রাখেন সিলেটের সহকারি পুলিশ সুপার ওসমানীনগর (সার্কেল) সাইফুল ইসলাম, বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস.এস. নুনু মিয়া, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সুহেল আহমদ চৌধুরী, রাজনীতিবিদ অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নান, মরহুম ফরিদ উদ্দিনের চাচা শুকুর আলী।
এছাড়া জানাযার নামাজে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পংকি খান, বিশ্বনাথ থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) শামীম মুসা, বিশ্বনাথ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছয়ফুল হক, মাওলানা আহমদ আলী হেলালী, ব্যবসায়ী হাজী উলফত আলী, সিরাজউদ্দিন এবং আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ব্যাংকার, ডাক্তার, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্থরের বিপুল সংখ্যক মানুষ।
সরেজমিন শুক্রবার সকালে ফরিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সিলেট শহর থেকে বাড়িতে লাশ আসার অপেক্ষায় পরিবার-স্বজনরা। এমন খবরে এলাকার লোকজন সকাল থেকে ফরিদকে শেষ বারের মতো একনজর দেখতে তাঁর বাড়িতে ছুটে আসেন। কখন আসবে লাশ। এর অপেক্ষায় তাঁর পরিবার, আত্বীয়-স্বজন ও এলাকার লোকজন। দুপুর ১২টা ২৫ মিনিট ফরিদের লাশ বহণকারী গাড়ি বাড়িতে প্রবেশ করছে। এতে উপচে পড়া লোকজনের ভিড়। পুরো বাড়িটি লোকজনে ভরপুর। অনেকেই নিরবে চোখের জল পালাচ্ছেন। লাশবহণকারী এ্যাম্বুল্যান্স বাড়ির আঙ্গিনায় রাখা হয়। এ্যাম্বুল্যান্স থেকে ফরিদের মৃতদেহ নামানো হয়নি। লাশ দেখতে আসা আগত লোকজনকে গাড়িতে লাশ রেখেই দেখতে দেয়া হয়। প্রথমে পুরুষ ও পরে নারীরা একে একে সারিবদ্ধভাবে ফরিদকে শেষ বারের মতো দেখতে শুরু করেন। প্রায় আধা ঘন্টা ফরিদের লাশ দেখেন আগত লোকজন। পরে তাঁর পরিবারের সদস্যরা শেষ বারের মতো দেখতে আসেন। এসময় ফরিদের মৃতদেহ দেখে জ্ঞানহীন হয়ে পড়েন তাঁর স্ত্রী। সকলের কান্নাকাটিতে ভারী হয়ে উঠেছে আশপাশ পরিবেশ। পরিবারের সদস্যদেরকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন পাড়া-প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনরা। ফরিদের একমাত্র মেয়ে শুধু সবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে থাকাচ্ছে। সে এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না, তাদের প্রিয় বাবা যে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বেলা ১টা ১০মিনিট ফরিদের নিজ গ্রাম কারিকোনা জামে মসজিদ প্রাঙ্গন নেয়া হয় তাঁর মৃতদেহ। সেখানে অপেক্ষমান শতশত মানুষ। সেখানেও তাঁর মৃতদেহ দেখতে ভিড় করেন মানুষ। পরে বাদ জুম্মা ফরিদের জানাযার নামাজ শুরু হয়। জানাযার নামাজ শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থান দাফন করা হয়েছে। ৬ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সবার বড় ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে রাশিয়া যান ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। খেলা শেষ হওয়ার মাস খানেক পর তিনি রাশিয়া থেকে ইউক্রেন যান এবং সেখান থেকে গত ২৮ আগস্ট দালালের মাধ্যমে ৫জন সঙ্গীর সাথে ইউক্রেন থেকে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে যাত্রা করেন ফরিদ। এরপর ২ সেপ্টেম্বর ফরিদের সঙ্গীরা ফ্রান্স পৌঁছলেও নিখোঁজ হয়ে যান ফরিদ। পরিবারের পক্ষ থেকে দালাল ও সঙ্গীদের সাথে যোগাযোগ করা হলে পরিবারের সাথে তারা নানান টালবাহানা করতে থাকে। একপর্যায়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর স্লোভাকিয়ার স্টারিনার এলাকার একটি পর্যটন স্পট থেকে ফরিদের মরহেদ উদ্ধার করে সেদেশের পুলিশ। ওই দিন অজ্ঞাতনামা যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে ‘জওজে টিভি’র বরাত দিয়ে সেদেশের ‘নোভেনী ডট এসকে’ নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংবাদটি প্রচার করে। ফরিদের স্বজনরা যুক্তরাজ্য থেকে স্লোভাকিয়ায় গিয়ে সেদেশের একটি মর্গে ফরিদ উদ্দিন আহমদের লাশ সনাক্ত করেন। এরপর লাশ দেশে নিয়ে আসতে তারা অনেক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। একপর্যায়ে লাশ বাংলাদেশে নিয়ে আসতে আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেন ফরিদের স্বজনরা। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অবশেষে দেশে আনা হয় ফরিদ উদ্দিন আহমদের লাশ।