পুলিশের অসতর্কতার কারণে এক আসামির সাজায় ৫৯ দিন হাজত খেটেছেন অন্য ব্যক্তি। জানা গেছে, যাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল তিনি আসামী শ্রী বাবু নন। তার নাম বাবলু শেখ।
নাটোরের মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতের একটি মারামারির মামলায় সিংড়া উপজেলার আঁচলকোট গ্রামের শ্রী দেবদাসের ছেলে শ্রী বাবুকে দুই বছরের দণ্ডাদেশ দেন। কিন্তু তার পরিবর্তে কারাগারে পাঠানো হয় ইয়াকুব আলীর ছেলে বাবলু শেখ নামের একজন চা বিক্রেতাকে।
আদালতের নথিপত্র ও বাদীর অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালের ১৫ এপ্রিল সদর উপজেলার গাঙ্গইল গ্রামে একটি মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কাজী আবদুল মালেক বাদী হয়ে শ্রী বাবুসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে নাটোর সদর থানায় একই সালের ১৮ এপ্রিল একটি মামলা করেন।
তৎকালীন নাটোর সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নমমিনুল ইসলাম শ্রী বাবুকে অভিযুক্ত করে ২০০১ সালের ১৫ মে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। পরবর্তীতে একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর পুনরায় শ্রী বাবুকে অভিযুক্ত করে সদর থানার এসআই হেলেনা পারভীনও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
মামলার এজাহারে উল্লেখিত আসামি বাবুকে গ্রেপ্তার না করে ইয়াকুব আলীর ছেলে বাবলু শেখকে ২০০২ সালের ৭ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ।
এই ভুলের বিষয়টি আদালতকে অবহিত না করে ছয় দিন পর ১৩ নভেম্বর আসামির আইনজীবী বাবু পরিচয়েই বাবলু শেখের জামিন করান। পরে ওই পরিচয়েই বাবলু শেখের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য গ্রহণ ও আসামি পরীক্ষা করেন।
যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৬ সালের ২৩ জুন মুখ্য বিচারিক হাকিম মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী আসামি বাবুর বিরুদ্ধে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন। ওই দিন কাঠগড়া থেকে বাবলু শেখকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনি একই বছর ১৬ আগস্ট আপিলের মাধ্যমে জামিনে বের হন।
এদিকে মূল ঘটনা জানতে স্থানীয় সাংবাদিকরা সদর উপজেলার গাঙ্গইল গ্রামে যান। মামলার বাদী কাজী আব্দুল মালেকের স্ত্রী ওলেগান বেগম সাংবাদিকদের জানান, তার স্বামী প্রায় ১৫ বছর আগে মারা গেছেন। তিনিসহ পরিবারের সবাই জানে এ মামলার কার্যক্রম এতদিনে স্থগিত হয়ে গেছে।
কাজী আব্দুল মালেকের ছেলে ও মামলার সাক্ষী বাতেন কাজী বলেন, ‘আমরা জানি যে, এতদিনে এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেছে।’ সাংবাদিক পরিচয় নিশ্চিত করলে বাতেন কাজী কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
একই গ্রামের বাসিন্দা ও এ মামলার সাক্ষী নবীউল্লাহ বলেন, শ্রী বাবু নামের কেউ অত্র এলাকায় নাই। তবে যে বাবলু শেখকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল এ মামলার সাথে তার সম্পৃক্ততা নেই।
আঁচলকোট গ্রামে গেলে কথা হয় গ্রামের বাসিন্দা মকছেদ আলী প্রাং, জনাব আলী ও গ্রাম্য ডাক্তার বিশ্বনাথ সরকারের সঙ্গে। তারা জানান, অত্র এলাকায় শ্রী বাবু নামের কেউ কোনোদিনই ছিল না। বাবলু শেখ এলাকার একজন সহজ-সরল মানুষ। তাকে ফাঁসানো হয়েছে।
বাবলু শেখ বলেন, ‘আমি বাবলু শেখ, শ্রী বাবু না।’ অন্য আসামিদের সঙ্গে আমি দিনের পর দিন আদালতে হাজিরা দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, সাক্ষ্য গ্রহণের সময় ভুল পরিচয়ের বিষয়টি জানার পর আইনজীবীর মাধ্যমে তার ভোটার পরিচয়পত্র আদালতে জমা দিয়ে ঘটনায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে কোনো সমাধান মেলেনি। তাই বিনা অপরাধে দুইবারে ৫৯ দিন কারাভোগ করতে হয়েছে তাকে।
বাবলু শেখের অন্যতম আইনজীবী দেওয়ান লুৎফর রহমান জানান, বাবলু শেখের জামিনের সময় অন্য আইনজীবী ছিলেন। পরে তিনি বাবলু শেখের জাতীয় পরিচয়পত্র আদালতে উপস্থাপন করে ত্রæটির বিষয়টি অবগত করেন। এরপরও তার সাজা হওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক।
বাবলু শেখের বর্তমান আইনজীবি শামীম উদ্দিন বলেন, মামলার তদন্তকারী দুইজন কর্মকর্তা ও আগের আইনজীবির গাফিলতির কারণে বিনা দোষে কারাভোগ করতে হয়েছে বাবলু শেখকে। তিনি পরবর্তী শুনানিতে খালাস পাবে বলে আমি আশাবাদী।
নাটোর সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফরিদুল ইসলাম বলেন, অনেক আগের বিষয়, না জেনে বলতে পারছি না। খোঁজ-খবর নিয়ে পরে বলতে পারব।