নওগাঁর নিয়ামতপুরে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের বাড়ি নির্মান কাজে নয়ছয়

নওগাঁ প্রতিনিধি ঃ দশ-পনের বছর আগে স্বামী মারা গিয়ে বিধবা হয়েছেন রোকেয়া বেগম। অন্যের বাড়িতে কাজ করে এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে চলে তার জীবন সংসার। বাড়ি করার মত সামান্য জমি থাকলেও অর্থের অভাবে বাঁশে-কুনচি দিয়ে তৈরী বেড়ার একটি মাত্র ঘরে সকলে মিলে থাকতেন। সম্প্রতি সরকার থেকে ‘জমি আছে, ঘর নাই’ আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের মাধ্যমে একটি আধাপাকা ঘর নির্মান করে দেওয়া হয়েছে। এতে খুশি রোকেয়া বেগম। প্রধানমন্ত্রীর নিকট কৃতজ্ঞ তিনি। তবে ঘর বুঝে দেওয়ার এক মাস না যেতেই দেখা যায় ঘরের উপরে ছাউনি ও নিচে মেঝের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকছে। জোরে বৃষ্টি হলে সব আসবাবপত্র ভিজে যায়, ঘরে থাকা যায় না। এছাড়া পায়খানা তৈরী করে দেওয়ার কথা থাকলেও শুধু সেনেটারী রিং দেওয়া হয়েছে। মিস্ত্রিরা আসব, আসতেছি বলে আর আসেনি। বকশিসের কথা বলে নেওয়া হয়েছে ৭শ টাকা।
এমন ঘটনা নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার চন্দননগর ইউনিয়নের ছাতড়া দক্ষীনপাড়া গ্রামের রোকেয়া বেগমের। এ উপজেলায় সরকারের ‘জমি আছে, ঘর নাই’ প্রকল্প নিয়ে চলছে এমন নয়ছয়। রোকেয়া বেগমের মত অন্যান্য ইউনিয়নেও খোঁজ নিয়ে একই চিত্র জানা গেছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় গৃহহীন পরিবারের জন্য ১৪৪টি আধাপাকা ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ টাকা। ঘর বরাদ্দ থেকে শুরু করে ঘর তৈরীতে চলছে নানান অনিয়ম। নি¤œমানের সামগ্রী দিয়ে পিলার তৈরী করা হয়েছে। ঘর নির্মাণ শেষ না হতেই পিলার ভেঙে গেছে। দরজা, জানালার কাঠে ফাটল দেখা দিয়েছে। জানলার পাল্লা করা হয়েছে দোকানের ঝাপ প্রকৃতির। আর যে রড দেওয়া হয়েছে তা কোন ছোটবাচ্চাা সামান্য টান দিলেই খুলে আসবে। ঘরের টিনের ছাউনিতে রুয়ার যে কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে তা একাধীক জোড়া দেওয়া কাঠ। ঘরের মালামাল বহন খরচ, মিস্ত্রি খরচ সহ সকল খরচ বরাদ্দ হতে করা কথা থাকলেও মালামাল বহনকারী ও মিস্ত্রি ৭শ-৮শ টাকা নিয়েছেন।
এ প্রকল্পের সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার হলেও পূরো কাজের খরচ ও দেখভাল করেছেন প্রকল্পের সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প ব্যাস্তবায়ন কর্রকতা তারিকুল ইসলাম। যে মানের কাজ করা হয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ৬৫ হতে ৭০ হাজার এর বেশী টাকা খরচ হয়নি বলে অনেকে মন্তব্য করেছে। ৭০ হাজার টাকা খরচের হিসেবে ১৪৪ টি ঘর নির্মান শেষে প্রায় ৫০ লক্ষ (অর্ধকোটি) টাকা অবশিষ্ট থাকবে। অথচ এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে কাজে নয়ছয় এর মাধ্যমে আতœসাত করেছেন প্রকল্পের সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প ব্যস্তবায়ন কর্মকতা তারিকুল ইসলাম বলে অনেকে অভিযোগ করেন।
রোকেয়া বেগম বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর অর্থের অভাবে ঘর করতে পারিনি। একটি ঘরে ছেলে- মেয়ে ও আমি তিনজন মিলে থাকতাম। কিছুদিন আগে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে থাকার খুবই সমস্যা। সেজন্য সরকারী ঘর পেয়ে খুবই উপকার হয়েছে। তবে যেভাবে ঘর করে দেওয়া হয়েছে তাতে বৃষ্টি হলে ঘরে থাকতে পারছি না। ঘরের মালামাল নিয়ে আসা গাড়ির ড্রাইভার ও মিস্ত্রিরা মিলে ৭শ টাকা নিয়েছে। টিনের বেড়ার নিচ দিয়ে ঢোকা পানি বন্ধ করতে দুই বস্তা সিমেন্ট কিনতে হয়েছে এবং পায়খানা তৈরীও আমার ছেলে দিন মজুর মানুষ নিয়ে নিজের টাকায় করতে হয়েছে।
উপজেলার শেফালী রানী ও ওহির উদ্দিন জানান, শুনেছি ঘর করার জন্য এক লাখ করে টাকা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী অথচ যে মানের ঘর নির্মান করা হয়েছে এতে সর্বোচ্চ হলে ৬০ হাজার টাকা খরচ হবে এর বেশি হবে না। বাঁকী টাকাগুলো কার পকেটে গেলো।

ভাবিচা ইউনিয়নের ডিমা গ্রামের বিশাবজিৎ সরকার বলেন, এখানে আনিছার রহমান নামে যে ব্যক্তিকে ঘর করে দেওয়া হয়েছে সে ভূমিহীন বা হতদরিদ্র নয়। তার কিছু আবাদি জমি ও পাশ্ববর্তী পাড়ায় নিজের নির্মানকৃত বাড়ী রয়েছে। অথচ যাদের জমি আছে কিন্তু ঘর নির্মানের সামর্থ্য নেই, তাদেরকে বাড়ি করে না দিয়ে যার বাড়ি আছে তাকেই দিয়েছে।

শ্রীমন্তপুর ইউনিয়নের শ্রীমন্তপুর বালুকাপাড়া গ্রামের সোহেল রানা জানান, এই গ্রামের শাহাজাহানকে যে ঘর করে দেয়া হয়েছে তার সরঞ্জামগুলো খুবই নি¤œ মানের। জানালায় যে রড ব্যবহার করা হয়েছে গরমের সময় রাতে জানালা খোলা রাখলে বাহির থেকে জানালার রড ধরে সামান্য টান দিলেই খুলে আসবে। আর ঘরের উপরের কোনে এক হাতের মধ্যে প্রায় শতাধীক পেরেক দিয়ে কয়েকটি কাঠের টুকরা জোড়া দিয়ে ছাউনি দিয়েছে। তা যে কোন সময় ভেঙ্গে গিয়ে চালের টিন উড়ে যাবে।

নিয়ামতপুর উপজেলা প্রকল্প ব্যস্তবায়ন কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, সরকারী নিয়ম মোতাবেক সকল বাড়ি নির্মান করা হয়েছে। নি¤œ মানের বাড়ি তৈরীর করার বিষয়টি সঠিক নয়। কোন প্রকার অর্থ আতœসাত করা হয়নি।

নিয়ামতপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়া মারিয়া পেরেরা জানান, বিষয়টি নিয়ে খোজ-খবর নিয়েছি। পিলার ভেঙ্গে- ফেঁটে যাওয়ার বিষয়টি ব্যবহারকারীর উপর নির্ভর করছে। আর্থিক অভিযোগটি সঠিক নয়। যে পরিমান অর্থ বরাদ্দ ছিল সে পরিমান অর্থই ব্যয় করে কাজ করা হয়েছে।