হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগের স্মৃতির অনুশীলনে মুসলিম সমাজে কোরবানির প্রচলন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবনব্যাপী আত্মত্যাগের দুরূহ-কঠিন পরীক্ষায় শতভাগ সাফল্যের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে অনাগত কেয়ামত পর্যন্ত সব মুসলিম মানসে জাগ্রত রাখার উদ্দেশ্যে সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর কোরবানিকে অপরিহার্য বিধান হিসেবে বিধিবদ্ধ করেছেন।
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিল নিজের প্রিয়তম পুত্রকে আল্লাহর নামে জবাই করা। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, সে (ইব্রাহিম) বলল, হে আমার রব! আমাকে একটি নেক সন্তান দান করো। সুতরাং আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রসন্তানের শুভসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে সন্তান যখন কাজেকর্মে তাকে সহযোগিতা করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন সে (পুত্রকে) বলল, প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি। সুতরাং তুমি ভেবে বলো এ বিষয়ে তোমার মতামত কী? সে (পুত্র) বলল, পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, পালন করুন। নিশ্চয়ই আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পাবেন। অতঃপর যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহিম তাকে (ইসমাইলকে) জবাই করার জন্য শায়িত করল। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্য প্রমাণিত করে দেখালে! আর আমি এভাবে সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল সুস্পষ্ট এক পরীক্ষা। আর আমি তার পরিবর্তে জবাই করার জন্য দিলাম এক মহান জন্তু। আর আমি তার জন্য এ বিষয়টিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি। (সুরা আস-সাফফাত, আয়াত : ১০০-১০৮)
হজরত ইব্রাহিম (আ.) মহান আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজের সমস্ত কামনা-বাসনাকে বিসর্জন দিয়ে আত্মোৎসর্গের যে মহান পরাকাষ্ঠা স্থাপন করেছিলেন, মহান আল্লাহর দরবারে তা অত্যন্ত পছন্দনীয় হয়েছিল। তাই তো অনাগত কেয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানব-মানসে ইব্রাহিমী প্রেরণা সজীব হয়ে থাকুক, প্রতিটি মুমিন আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজের যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকুক—এ উদ্দেশ্যে উম্মতে মোহাম্মদীর ওপর কোরবানি করাকে ওয়জিব করা হয়েছে।
ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক সামর্থ্যবান পুরুষ ও নারীর পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট শ্রেণির পশুর মধ্য হতে যেকোনো একটা পশুকে জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সালাতুল ঈদ আদায়ের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আল্লাহর নামে জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নামে কোরবানি করেছিলেন নিজের ঔরসজাত সন্তানকে। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইসমাইলকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর স্থানে বেহেশতি জন্তু স্থাপন করে একদিকে স্বীয় নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছিলেন, অন্যদিকে এ কথাও প্রমাণ করেছিলেন যে মানবসমাজে নরবলি প্রথা চালু করা কোনোক্রমেই তাঁর ইচ্ছা নয়। তিনি শুধু চান, প্রতিটি মুমিন সর্বান্তকরণে তাঁর প্রতি অনুগত থাকুক। সুতরাং কোরবানিতে আল্লাহতায়ালার সন্তষ্টি অর্জন করা উদ্দেশ্য না হয়ে যদি মাংসভক্ষণই মুখ্য হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা হবে পশু হত্যারই নামান্তর। অতএব, ভোগ নয়, ত্যাগই হোক সব মুমিনের কোরবানির আসল প্রেরণা।