২১ জুলাই জাসদের সৃষ্টি – কর্ণেল তাহেরের মৃত্যু

।। আমিরুল ইসলাম রাঙা ।।
২১ জুলাই জাসদ রাজনীতির জন্য একটি বিশেষ দিন। জাসদ নেতাকর্মীরা এই দিনটি কর্নেল তাহের দিবস হিসেবে পালন করেন। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমকে মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ।

           ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে বন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার দুই সপ্তাহের মধ্য জিয়ার সামরিক সরকার কর্তৃক গ্রেপ্তার হোন। এরপর জেলখানার মধ্য  অাদালত বসিয়ে ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। পরিশেষে রায় ঘোষনার চারদিন  পর ২১ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী, মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো একমাত্র যুদ্ধাহত সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। সেই থেকে জাসদ ২১ জুলাই শহীদ তাহের দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

অথচ এই দিবসের সাথে জাসদ রাজনীতির এক বিরাট ইতিহাস চাপা পরে আছে। যেটা এ প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানা। ১৯৭২ সালে ২১ জুলাই ছাত্রলীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দিয়ে ছাত্রলীগের আসম আব্দুর রব এবং শাহজাহান সিরাজ গ্রুপ বিভক্তির তিনমাসের ভিতর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদ গঠন করেন। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে জাসদ প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দেওয়া হলেও জাসদ সৃষ্টির বীজ অঙ্কুরিত হয় ১৯৭২ সালের ২১ জুলাই ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলনকে কেন্দ্র করে।

আজ থেকে ঠিক ৪৪ বছর আগের কথা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৬ মাস সময়কালের মধ্য মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি ছাত্রলীগের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়। একপক্ষ মুজিববাদ আরেকপক্ষ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শ্লোগান তুলে ছাত্রলীগে বিভক্তির সূচনা করে। মুক্তিযুদ্ধ কালীন চার খলিফা হিসেবে খ্যাত নুরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুজিববাদের পক্ষে এবং আসম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেন। এর বিরুপ প্রভাব পরে সারাদেশব্যপী।

আমি তখন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের একজন সাধারন কর্মী। জেলা ছাত্রলীগের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইছামতি পত্রিকার সম্পাদক ও দৈনিক গনকন্ঠের পাবনা প্রতিনিধি। আমার প্রধান নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল ও ফজলুল হক মন্টু। তাঁরা রব গ্রুপ ছাত্রলীগ হওয়ায় আমিও রব গ্রুপ। আমরা প্রথমতঃ জানতাম বঙ্গবন্ধু স্বয়ং আমাদের পক্ষে। সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ আমাদের দিকে আছেন। তখন আমাদের বক্তব্য ছিল, আমরা লড়ছি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শ্রেনী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পরে পাবনায় আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে এক বিরাট নেতৃত্ব শুন্যতা বিরাজ করছিল। জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আমজাদ হোসেন এমএনএ যুদ্ধের শুরুতে হৃদরোগে এবং সেক্রেটারি আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ স্বাধীন হবার পরে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান। অল্পদিনের মধ্য ওয়াজি উদ্দিন খান, গোলাম কাদেরী সহ ১১ জন প্রথম সারির আওয়ামীলীগ নেতাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। তখন মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং তাঁর পুত্র মোহাম্মদ নাসিম পাবনার স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন।

         জুন মাসের শেষের দিকে পাবনা টাউন হলে ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা ডাকা হলো। কেন্দ্রীয় সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী প্রধান অতিথি।  ফজলুল হক মন্টু ( বর্তমান কেন্দ্রীয় শ্রমিকলীগের কার্যকরী সভাপতি) আগেই আমাদের জানালেন, বকুল মুজিববাদের পক্ষ নিবে। আমরা যেন রব গ্রুপে থাকি। নির্ধারিত সভায় বকুল ও মন্টু ভাই গ্রুপ ত্যাগ করলেও আমরা রব গ্রুপে থেকে গেলাম। রাতেই পাবনা পলিটেকনিকের জি,এস আব্দুল হাই তপনকে আহবায়ক এবং আমাকে যুগ্ম আহবায়ক করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট রব গ্রুপ ছাত্রলীগের পাবনা জেলা কমিটি গঠন করা হয়। এরপর ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতা অখিল রঞ্জন বসাক ভানু , খোন্দকার আওয়াল কবীর, ইশারত আলী জিন্নাহ প্রমুখ নেতারা যোগ দিলে আমাদের পক্ষ শক্তিশালী হয়ে উঠে।

           এরপর ২১ শে জুলাই ঢাকায় ছাত্রলীগের সম্মেলন। একই দিন পল্টন ময়দানে রব গ্রুপ এবং রেসকোর্সে মুজিববাদী গ্রুপ। আমরা শেষ সময়েও জানতাম বঙ্গবন্ধু আমাদের সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। পরিশেষে আমাদের নিরাশ করে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের সম্মেলনে যান। যাইহোক আমরা ২০ শে জুলাই পাবনা থেকে বিরাট বহর নিয়ে ট্রেনযোগে ঢাকা রওয়ানা দিলাম। তখনতো ট্রেন ছাড়া ঢাকা যাওয়া কঠিন। আগেরদিন দুপুরে ঈশ্বরদী থেকে মেইল ট্রেনে উঠে সিরাজগঞ্জ ঘাট। ষ্টিমারে পার হয়ে জগন্নাথগঞ্জ  ঘাট।  আবার ট্রেনে উঠে পরেরদিন ১০/১১ টায় ঢাকার কমলাপুর পৌছালাম। পল্টন ময়দানে আমাদের সম্মেলন। হাজার হাজার ছাত্রজনতার সমাবেশ। ২ দিনব্যাপী সম্মেলনের ২য় দিন কাউন্সিল অধিবেশন। শরীফ নুরুল আম্বিয়া সভাপতি এবং আফম মাহবুবুল হক সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। নতুন নেতাদের নিয়ে পল্টন ময়দান থেকে শহীদ মিনার অভিমুখে মিছিল। বিরাট মিছিল যখন কার্জন হলের কাছে তখনই প্রতিপক্ষ গ্রুপের হামলা। রব ভাই, মাহবুব ভাই, মমতাজ আপা সহ শত শত নেতা কর্মী আহত হতাহত হলেন। আপন বন্ধুরা তখন ভয়ঙ্কর শত্রু হলেন। পাবনা ফিরে আসার পর এক কঠিন পরিস্থিতির মাঝে পড়লাম। ছাত্রলীগের বিভক্ত হবার তিন মাস দশদিন পর ৩১ শে অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর এম,এ জলিল এবং আসম আব্দুর রবকে যৌথভাবে আহবায়ক ঘোষনা করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল - জাসদ গঠিত হয়।

            এ সময়ে পাবনা সহ বাংলাদেশের সকল জেলায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল বামধারার রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জাসদ গঠনে এগিয়ে আসেন। পাবনায় ষাটের দশকের ডাকসাইট নেতা, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রবিউল ইসলাম রবিকে আহবায়ক, সাবেক মুজিববাহিনী প্রধান মোহাম্মদ ইকবাল, জামিল আহমেদ, মকলেছুর রহমান মুকুলকে যুগ্ম আহবায়ক করে জাসদ গঠিত হয়। ঈশ্বরদীর প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু, আমিনুল ইসলাম চুনু সরদার, কাজী সদরুল হক সুধা, খায়রুজ্জামান বাবু, গোলাম মোস্তফা বাচ্চু, লুৎফর রহমান মাষ্টার, মুক্তিযোদ্ধা আন্নি সহ প্রমুখ নেতাদের সমন্বয়ে ঈশ্বরদী থানা জাসদ গঠিত হয়। আটঘরিয়ায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন রেনু, আলী আশরাফ,  আবুল কাশেম মুন্সি, সাদেক আলী বিশ্বাস,হাসান আলী প্রমুখের সমন্বয়ে জাসদ গঠিত হয়। সাঁথিয়ায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার নিজাম উদ্দিন, সুজানগরে যুদ্ধকালীন কমান্ডার আহসান হাবিব, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের তৎকালীন জিএস, আওয়াল কবীর, অধ্যক্ষ আমিরুল ইসলাম,  বেড়ায় আব্দুল হাই, ফুল, বনওয়ারীনগর ফরিদপুরে গোলাম হোসেন গোলাপ, চাটমোহরে শেখ ইউনূছ, আবুল কাশেম, শহীদুল্লাহ পলাশ, আসাদুজ্জামান আরশেদ প্রমুখ এর নেতৃত্বে জাসদ গঠিত হয়। 

         স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে গঠিত প্রথম রাজনৈতিক দল জাসদ জনমনে আশার আলো দেখিয়েছিল। দীর্ঘ সময় অন্যতম প্রধান দল হিসেবে পরিগনিত হয়েছে। কালের পরিক্রমায় দল ভেঙ্গেছে। প্রতিষ্ঠাকালীন নেতারা দলত্যাগ করেছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী মৃত্যুবরন করেছে। প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না থেকেও দলটি টিকে আছে। স্যালুট সেই সব নেতাকর্মীদের যারা শত লোভ লালসা উপেক্ষা করে জাসদের পতাকাতলে সমাবেত থেকে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে অন্ধকার পথে আলো জালিয়ে হেঁটে চলেছেন। অন্তরে বিশ্বাস অপরিসীম। নিশ্চিত - রাজনীতির এই ঘোর অন্ধকার দূর হবে। নিকট ভবিষ্যতে জাসদ শক্তিশালী হবে এবং ঘুষ, দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। জাসদ দীর্ঘস্থায়ী হোক - মেহনতি জনতার জয় হোক।  জয় বাংলা।

————- সমাপ্ত ——

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
২০ জুলাই ২০১৬