একুশে পদক প্রাপ্ত প্রয়াত সাংবাদিক ও কলামিস্ট রণেশ মৈত্র স্মরণে–

— এবাদত আলী —
পাবনা জেলায় স্ংবাদিকতার দ্বার উন্মোচনে যাঁদের নাম স্মরনীয় বরনীয় হিসাবে উচ্চারিত হয় তাঁদের মধ্যে অগ্রপথিক হলেন সাংবাদিক ও কলামিষ্ট রণেশ মৈত্র। একজন বর্ষিয়ান রাজনীতিক ও আইন পেশার পাশাপাশি জীবনের প্রায় প্রতিটি মূহুর্তেই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন এ যাবত কাল। সমগ্র বাংলাদেশে বিশিষ্ট কলামিষ্ট হিসাবে যাঁর নাম খ্যাতির শীর্ষে নিরন্তর সাফল্য গাথা এমনি এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী আমার শ্রদ্ধাভাজন প্রিয় রণেশ’দা। । সাংবাদিক, কলামিস্ট রণেশ মৈত্রের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ষাটের দশকের শেষ দিকে। আমি তখন সবেমাত্র পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে প্রথম বর্ষ মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়েছি। পাবনা শহর থেকে আমার গ্রামের বাড়ি বেশ দুর হওয়ায় আমি তখন জায়গির থাকতাম শহরতলির বাহাদুরপুর-গোপাল পুরে। অনুন্নোত এই এলাকায় তখন না ছিল রাস্ত্া-ঘাট না ছিল জনসাধারণের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা।
এক সময় এই গোপালপুর, বাহাদুরপুর ও বৈকুন্ঠপুর গ্রামে মহামারি আকারে কলেরা রোগ দেখা দিল। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন মারাও গেল। আক্রান্তের সংখ্যাও দিন দিন বাড়তে লাগল। গ্রামের কয়েকজন যুবককে সাথে নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগে গেলাম। তেমন কোন প্রতিকারের আশ^াস পাওয়া গেলনা। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তা ব্যক্তি জানালেন, ঢাকাতে চিঠি লিখেছি ওষুধ এলেই সিনেটারি ইনেস্পেক্টর গ্রামে যাবে কলেরা ভ্যাকসিন দিতে। গেলাম সদর মহকুমা প্রশাসক বা এসডিও র কাছে। তাঁকে বিষয়টি জানানো হলো । তিনি মনযোগ দিয়ে শুনলেন আমাদের কথা। তিনি বলে¬ন ভ্যাকসিনের বড়ই অভাব। তবুও আশ্বাস দিলেন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার।
আমরা এখানে ওখানে ঘুরা-ঘুরি করি উদ্ভান্তের মত। জেলা প্রশাসকের কাছেও যাই। সবারই একই কথা। অগত্যা মাথায় বুদ্ধি এলো বিষয়টি সাংবাদিকদেরকে জানানো দরকার। কিন্তু সাংবাদিক পাবো কোথায়? তখনকার দিনে সংবাদপত্রের সংখ্যা যেমন কম, তেমনি সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা হওয়া ছিল দারুন সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই সাংবাদিকের খোঁজ করতে লাগলাম। অগত্যা খোঁজ পেলাম পাবনা শহরের নতুন গলিতে প্রেসক্লাব আছে , সেখানে সন্ধ্যা বেলা সাংবাদিকদের দেখা পাওয়া যায়। গেলাম প্রেসক্লাবে। প্রথমেই যার দেখা পাওয়া গেল তিনি হলেন সাংবাদিক রণেশ মৈত্র। তাঁকে ঘটনা খুলে বল¬াম। এসডিও বরাবর লেখা দরখাস্তের কার্বন কপি দেখানো হলো। তিনি গভীরভাবে পড়লেন এবং সবকিছু নোট করে নিলেন। সেই সাথে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করলেন। সবশেষে বলে¬ন ঠিক আছে বিষয়টি আমরা দেখছি। এদিন কি দুদিন পর খবরের কাগজে তা ছাপা হলো।
সাংবাদিকদের দ্বারা যে কত দ্রুত কাজ হয় তা পত্রিকার পাতায় খবর ছাপা হবার পরেই বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলেন কলেরা রোগে আক্রাস্ত গ্রামবাসিও। যেন তেলেসমাতি কারবার। ডিসি, এসডিও, জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, মহকুমা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের গমনাগমণ শুরু হয়ে গেল। এলাকায় জিপ চলাচলের রাসআত না থাকায় ময়দানপাড়ায় গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে তাঁরা কলেরা আক্রান্তদের পাশে এসে হাজির হলেন। শুধু কি তাই, এলাকায় এক মাসের জন্য একটি স্বাস্থ্য ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। কয়েক দিনের মধ্যেই গোটা এলাকা কলেরা মুক্ত হলো। এলাকার মানুষজন আমাদেরকে খুব প্রশংসা করলেন।
এ ঘটনার পর রণেশ’দার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল। বাড়লো সাংবাদিকদের প্রতিও। লেখালেখির অভ্যাস আমার আগে থেকেই ছিল,তার সাথে সাংবাদিকতার প্রতিও আমি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। পরবর্তীকালে কর্মজীবনে প্রবেশ করে সরকারি চাকুরির আড়ালে আবডালে নিজেকে পত্রিকার সংবাদদাতা হিসাবে প্রকাশ করার সুযোগ করে নেই। আর সে সুবাদেই রণেশ’দার কাছাকাছি আসার সুযোগ পাই।
১৯৭৮ সালে পাবনার আটঘরিয়া থানার বেরুয়ান গ্রামের প্রতিভাবান তরুন আমিরুল ইসলাম রাঙা, হাসান আলী, কয়রাবাড়ি গ্রামের মোহাম্মদ ইয়াছিন, রাধাকান্তপুরের আব্দুস সাত্তার মিয়া, আটঘরিয়া থানার তৎকালিন পশু ডাক্তারের ছেলে এস দাহার মাতলু সহ উৎসাহি তরুনদের উদ্যোগে এবছর ৭ মে তারিখে ‘ আটঘরিয়া প্রেসক্লাব’
প্রতিষ্ঠিত হয়। আমি সৌভাগ্যবশতঃ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পাই। হয়তো বা সে সুবাদেই পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সাংবাদিক ও অ্যাডভোকেট রণেশ মৈত্র, সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবি, আজম আব্দুল আওয়াল, আনোয়ারুল হক, হাসনাতুজ্জামান হীরা, শিবজিত নাগ, মির্জা শামসুল ইসলাম, আব্দুল মতীন খানসহ পাবনা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের সান্নিধ্য লাভের অধিকতর সুযোগ লাভ করি।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার মিলনায়তনে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির ত্রি-বার্ষিক সন্মেলনে রণেশ মৈত্রের ভুমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আর তাই আমরা তাঁকে কেন্দ্রীয় সভাপতি পদে নাম প্রস্তাব করি। মুহুর্মূহ করতালির মাধ্যমে গোটা হাউজ তা সর্মনও করে। কিস্তু পরবর্তীকালে চক্রান্তের জালে জড়িয়ে তা বাতিল হয়ে যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের রজত জয়ন্তি পালন উপলক্ষে ১৯৯৬ সালে পাবনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে “ স্মৃতি অম্লাান” নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়। স্মরণিকা উপ-পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কবি অসিত কুমার মুকুট মনি। আর সদস্য ছিলেন এ্যাডভোকেট ও সাংবাদিক রণেশ মৈত্র, সাংবাদিক আবদুল মতীন খান ও সাংবাদিক আখতারুজ্জামান আখতার। রাজস্ব প্রসাশনে চাকুরির সুবাদে এ ডিসি (রাজস্ব ) কবি অসিত কুমার মুকুট মনির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল এবং তিনি জানতেন যে,মহান মুক্তিযুদ্ধের পাবনা জেলার অতি গুরুত্বপুর্ন ঘটনার দুর্লভ চিত্র এবং বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত আমার সংগ্রহে রয়েছে। তাই তিনি আমাকে টেলিফোনে ডেকে নিয়ে রণেশ’দার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। সেই সাথে আমাদেরকে ডিসি পুলের একটি জিপগাড়ি এবং ড্রাইভার আনছার আলীকে আমাদের সাথে আমার দায়িত্বে দিয়ে দিলেন পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের বাদ-বাকি তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য। আমি শ্রদ্ধেয় রণেশ’দাকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কদিন ধরে জেলার ৯টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করি এবং আরো কিছু দুর্লভ ছবি তুলি যা স্মরণিকা “স্মৃতি অম্লান” এ সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
১৯৯৫ সালে আমি পাবনা প্রেসক্লাবের সদস্যপদ লাভ করি। আর তখন থেকেই অন্যান্য সাংবাদিকদের পাশাপাশি পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রবীন সাংবাদিক ও কলামিস্ট এ্যাডভোকেট রণেশ মৈত্রের সাথে আমার সখ্যতা বৃদ্ধি পায়। বলতে গেলে কলাম লেখার ক্ষেত্রে তিনি আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করতেন। জটিল বিষয়ে কোন পরামর্শ কিংবা কোন তথ্য উপাত্তের ঘাটতি পড়লেই আমি ছুটে যাই পাবনা শহরে তাঁর আলিমুদ্দিন খাঁন (সাবেক বেলতলা রোড) রোডের ২/৩ রাঘবপুর বাসায়। বৌ’দির (পুরবী মৈত্রের) হাতের ঝাল-মুড়ি, টোষ্ট বিস্কুট আর চায়ের মাঝে আমি নানা প্রশ্নে রণেশ’দাকে বিরক্ত করি। কিন্তু ক্লান্তিহীন এই ব্যাক্তিটিকে কোন দিন বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখিনি।
২০০১ সালের ৫ জানুয়ারি এ আর সিমেন্টের সৌজন্যে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে পাবনা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের এক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এতে দুটি দলে ভাগ করা হলে আমি রণেশ’দার বিপক্ষ দলে পড়ি। তবে বর্ষিয়ান এই খেলোয়াড়কে নিয়ে খেলা জমেছিল বেশ ভালোই। ২০০৬ সালের ৮ এপ্রিল তারিখে পাবনা প্রেসক্লাবের বার্ষিক স্পোটর্স এন্ড ফ্যামিলি ডে তে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদক দলের মধ্যে আরেকটি ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতির দলের নাম ‘যমুনা’এবং সম্পাদকের দলের নাম ‘পদ্মা’। রনেশ’দা ও আমি এবার সম্পাদক এবিএম ফজলুর রহমানের পদ্মা দলের খেলোয়াড় হিসাবে স্থান লাভ করি। কিন্তু এই খেলায় মাত্র ২০ ওভারে ৮৭ রান করে সব কটি উইকেট হারিয়ে পদ্মায় হাবু-ডুবু খেতে হয় আমাদেরকে।
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট রনেশ মৈত্রের পুত্র কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার প্রবীর মৈত্র থাকেন অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। সেই সুবাদে তিনি মাঝে মধ্যেই অষ্ট্রেলিয়াতে গিয়ে তাঁর ছেলের বাসায় অবস্থান করেন। তাঁর শারিরীক চিকিৎসাও চলে সেখানে। কিন্তু তাঁর সাথে আমার যোগাযোগের ঘাটতি হয়নি কোন দিনই। সিডনিতে আমি তার কাছে নিয়মিত চিঠি লিখি। তিনিও কাল বিলম্ব না করে চিঠির উত্তর দেন।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লেখেন,—
প্রিয় এবাদত,
পবিত্র ঈদ-উল আযহা উপলক্ষে আন্তরিক শুভেচ্ছা নেবেন সস্ত্রীক এবং ছেলে-মেয়েদেরকে জানাবেন ঈদের সুভাশীষ। আপনাকে আর এক দফা চিঠি দিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি পাননি……। কেমন আছেন ? ভালো নিশ্চয়ই সবাই। আমি একাই শুধু বিচ্ছিন্ন।…….। ২৯শে জানুয়ারি ফেরার সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম. কিন্তু যেতে পারলামনা। ডাক্তার, আত্মীয় স্বজন, শুভাকাংখীদের চাপে। সবাই চায় চিকিৎসা শেষ করে তবে ফিরি। সবার কাছে তাই আত্মসমর্পন করা ছাড়া গত্যান্তর ছিলনা। এখন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে অবশ্যই ফিরছি। উত্তর পেলে খুবই অনন্দ পাবো। ভালো থাকুন।
পুনর্বার শুভেচ্ছা নিন।– ইতি রণেশ মৈত্র।
২০০৮ সালে তিনি যখন পুনরায় অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতে যান তখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের একটি বাড়তি সুবিধা পাই তা হলো আমার পিসিতে ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়া হয়। তাই যখন খুশি আমার প্রিয় রণেশ’দাকে ই-মেইল করি। তিনিও তার জবাব দেন সঙ্গে সঙ্গে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট রণেশ মৈত্র সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার প্রদত্ব দ্বিতীয় সর্বোচ্য বেসামরিক সন্মাননা একুশে পদকে তাঁকে ভুষিত করা হয়। পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সাংবাদিক কলামিস্ট রণেশ মৈত্রের সাথে আমার শেষ দেখা পাবনা প্রেসক্লাবের ২০২২ সালের দ্বিবার্ষিক নির্বাচনের দিন। আগামি ৪ অক্টোবর আমার প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন রণেশ’দার ৯০ তম জন্ম দিন পালনের কথা ছিলো। তার আগেই গত ২৬ সেপ্টেম্বর সকালে হঠাৎ করেই তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাই।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
তাং ২৫ / ০৯/২০২৩