// এবাদত আলী
(সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে ফিরে আসার পর ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বিদেশী সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন‘‘ যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারেনা। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সেটাতো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না তা কেউ পারেনা। এটাঁই আমার বিশ্বাস। )
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সকালটা শুরু হয়েছিলো ‘রেডিও পাকিস্তানের’ এমন ঘোষণা শুনে। ‘‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও তার সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ বিডিআর ও রক্ষীবাহিনীর সিপাহী ভাইবোনেরা আপনারা সবাই সেনাবাহিনীর সাথে যোগদান ও সহযোগিতা করুন। যাহারা অসহযোগিতা করিবেন , দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের চরম দন্ড দেওয়া হইবে। মেজর ডালিম জনগণকে আরো জানিয়েছিলেন: আপনারা নিশিচন্তে থাকুন, কোন অসুবিধা নাই।’’ এদিন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ভোরবেলা সু-পরিকল্পিতভাবে পৈশাচিক এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। দিনটি ছিলো শুক্রবার। সকাল সন্ধ্যা কারফিউ জারি করে রেডিওতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো যাতে কেউ পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত নিজ নিজ বাড়ি ঘর থেকে বের না হয়। তবে দুপুরের আগে সংবাদে জাননো হয় জনগণ যাতে জুম্মার নামাজ আদায় করতে পারে সেজন্য রাষ্ট্রপতি আজ দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে ২টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ফারুক হোসেন নামে রেডিও পাকিস্তানের একজন ঘোষক সেদিনের ঘোষণাগুলো সঞ্চালন করছিলেন। তিনি একটু পরপর ব্যুলেটিন পাঠ করে জানিয়ে যাচ্ছিলেন ‘ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। মাঝে জাতীয় সঙ্গীতের সুরে বাজিয়ে জাননো হয় এখন বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ। প্রেসিডেন্ট জাতিকে আস্সালামু আলাইকুম জানিয়ে বলেন, আজ ঐতিহাসিক প্রয়োজনে দেশ এবং দেশবাসির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা এবং দেশবাসির উপর নির্ভর করে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
ভোরবেলা এমন খবরে গোটা বঙালি জাতি হয়েছিলো স্তব্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারিরা স্বদম্ভে এমন আস্ফালন করায় গোটা দেশবাসি তখন স্তম্ভিত।
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহনকারী মানুষটিকে সাড়ে তিনবছর আগে সিংহাসনে বসানো হলো ; অথচ তাঁর মৃত্যু সংবাদে করা গেলনা কোন প্রতিবাদ। অনুষ্ঠিত হলোনা কোন মিটিং মিছিল কিংবা শোকসভা। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থানকারি বাংলার নয়নমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এমন কি অপরাধ করেছিলেন যে, তাঁকে এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে অকাতরে জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হলো?
অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান মুিক্তযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ২৫ মার্চ একাত্তর, রাতের বেলা বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে বসে। তারা নির্বিচারে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। বাংলার অকু তোভয় জনগণ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর,আনসার বাহিনী এবং এদেশের তরুণ সমাজ পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
দীর্ঘ নয় মাস একটানা যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর উদিত হয় বাংলার স্বাধীনতার লাল সুর্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। দেশ স্বাধীন হলো অথচ স্বাধীনতার স্থপতি দেশে ফিরে এলেন না এটা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে অসহ্য বেদনাদায়ক। তাই সবার কন্ঠই সোচ্চারিত হয়ে উঠলো ‘আমরা আমাদের প্রানপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে ফেরত চাই। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তাঁর মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দো‘য়া প্রর্থনা করতে থাকে। বাংলার মা-বোনেরা তাঁর মুক্তি ও সুস্থ্যতা কামনায় নফল রোজা পালন করে। জুম্মার নামাজের দিন তাঁর মুক্তির জন্য মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোওয়া ও মোনাজাত করা হয়। দেশের হিন্দুধর্মাবলম্বীসহ অন্যান্য ধর্মের লোকেরা নিজ নিজ উপসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনায় মিলিত হয়। (চলবে)
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।