বগুড়ায় শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নেতৃত্ব বিকাশে সাফল্য আনছে এনসিটিএফ

সঞ্জু রায়, বগুড়া: নেতৃত্ব বিকাশের মাধ্যমে শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় বগুড়ায় সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে জাতীয় পর্যায়ের শিশু সংগঠন ন্যাশনাল চিলড্রেন’স টাস্ক ফোর্স (এনসিটিএফ)। সংগঠনটির সাথে যুক্ত শিশুরা যেমন নেতৃত্ব বিকাশের মাধ্যমে নিজেদের সুপ্ত প্রতিভাগুলোকে বিকশিত করছে তেমনি জেলার সুবিধাবঞ্চিত ও নির্যাতিত শিশুদের পক্ষে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে সচেতনতার বলয় সৃষ্টিতে কাজ করছে। শুধু তাই নয় কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সচেতনতা সৃষ্টিতে ছোটদের এই সংগঠন বেশ ইতিবাচক কাজ করে যাচ্ছে যা প্রশংসিত হচ্ছে বগুড়ার সর্বমহলে।

আন্তর্জাাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্লান ইন্টারন্যাশনাল এবং ইয়েস বাংলাদেশের সহযোগিতায় ওয়াই মুভস্ প্রকল্পের মাধ্যমে বগুড়ার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবী ও উদ্যোমী শিক্ষার্থীদের এই সংগঠন বিভিন্ন সময় শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে শিশু বান্ধব বগুড়া গঠনে যেমন কাজ করছে তেমনি স্কুলভিত্তিক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তৈরি করছে নতুন নেতৃত্ব যাতে প্রতিবছর জেলা ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ পাচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও।

এনসিটিএফ বগুড়া এই সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আফিয়া ইবনাত নকশির সাথে কথা বললে সে জানায়, সে ছোট থেকেই অনেক লাজুক ও ভীত ধরণের ছিলেন। কিন্তু এনসিটিএফ পরিবার তার ভিতরে থাকা নেতৃত্বের গুণকে বিকশিত করেছে। নকশি বলেন, আজ সে যে কোন ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অনর্গল কথা বলতে পারে তার মাঝে নেই কোন জড়তা। নকশি বলেন, গত বছর জাতীয় কণ্যা শিশু দিবসে গালর্স টেক ওভার শীর্ষক ওয়াই মুভস্ প্রকল্পের একটি কর্মসূচির মাধ্যমে সে ১ ঘন্টার জন্যে বগুড়া জেলা প্রশাসকের প্রতীকি দায়িত্ব পালন করেছেন যা ছিলো তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। নকশির বর্তমান স্বপ্ন সে শুধু ১ ঘন্টার জন্যে নয় ভালভাবে লেখাপড়া শেষ করে সত্যিকারের জেলা প্রশাসক হয়েই সে দেখাবে যার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ পরিশ্রমও করবে সে।

এনসিটিএফ বগুড়ার শিশু সাংসদ ও ২০তম চাইল্ড পার্লামেন্টে ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হওয়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী মাহমুদ আল জিহাদের সাথে কথা বললে সে জানায়, উক্ত সংগঠনে সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকে সে যেমন এখন নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলতে শিখেছেন তেমনি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কণ্ঠস্বর হয়েও কাজ করতে পারছে যাতে সে নিজেকে সর্বদা সৌভাগ্যবান মনে করে। ইতিবাচক নানা কাজের সাথে থাকার কারণে তার পরিবার ও বন্ধুমহলেও তৈরি হয়েছে আলাদা গ্রহণযোগ্যতা যা তাকে আরও ভাল কাজের অনুপ্রেরণা যোগায়।

সংগঠনটির কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, সংগঠনটি শিশুদের দ্বারাই গঠিত ও পরিচালিত। প্রতি ২ বছর পর পর গণতান্ত্রিক উপায়ে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তারা নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করে। শিশু অধিকার বাস্তবায়নে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি সংগঠনটি শিশুদের অধিকার আদায়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্মারকলিপি প্রদান, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শিশুরা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে কি না বা সেখানে কোন অসংগতি আছে কি না তা নিয়মিত মনিটরিংকরণ সাথে সাথেই সমস্যা চিহ্নিত করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে তা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া, বিভিন্ন দিবস উদযাপন, নিয়মিত মাসিক সভার আয়োজন এবং নেতৃত্ব বিকাশে সারাবছর নানামুখী সৃজনশীল কার্যক্রম পরিচালনা, প্রতি মাসে পেপার কাটিং এর মাধ্যমে শিশু নির্যাতনের ঘটনা চিহ্নিত করে তা সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, শিশু অধিকার সংক্রান্ত প্রতি মাসে গল্প লেখাসহ নানা ইতিবাচক কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। তবে ওয়াই মুভস্ প্রকল্পের মাধ্যমে সংগঠনটি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিতে যা প্রশংসিত হচ্ছে সরকারি দায়িত্বশীল মহলেও। ছোট ছোট এই শিশু নেতৃবৃন্দরা মাঝে মাঝেই ছুটে যান বিভিন্ন স্কুলে কিংবা এলাকার সাধারণ মানুষদের মাঝে যেখানে তারা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেন। সাথে সাথেই কোথায় গেলে কি সেবা তারা পাবে সেটিরও প্রচার করেন যা সত্যিই ভাবিয়ে তোলে যে ছোট শিশুরা কিভাবে বৃহৎ একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নে কাজ করছে।

এ প্রসঙ্গে বগুড়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও স্বাচিপ বগুড়ার সভাপতি ডা: সামির হোসেন মিশু জানান, বর্তমান সরকার তৃণমূল পর্যায়ে কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে এনসিটিএফ বগুড়া যেভাবে উক্ত বিষয়ে তাদের সহযোগিতায় তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতার বলয় তৈরিতে কাজ করছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ডা: মিশু জানান, তিনি দীর্ঘ বছর যাবত এনসিটিএফ বগুড়ার নানা ইতিবাচক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হয়েছেন তিনি দেখেছেন এখানে শিশুদের নেতৃত্ব বিকাশের দারুণ সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র যা চলমান রাখার আহ্বান জানান তিনি।

এনসিটিএফ বগুড়ার কার্যক্রম সম্পর্কে বগুড়া সদর থানার নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক সার্ভিস ডেস্ক কর্মকর্তা এসআই জেবুন্নেছার সাথে কথা বললে তিনি জানান, বাংলাদেশ পুলিশের এক অনন্য উদ্ভাবন প্রতিটি থানায় তাদের বিশেষায়িত ডেস্ক যেখানে প্রতিনিয়ত শিশু অধিকার নিশ্চিতে নানা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে এনসিটিএফ বগুড়ার শিশু নেতৃবৃন্দরা। তিনি শিশুদের এই কার্যক্রমে এতটাই সন্তুষ্ট যে তার নিজের সন্তানকেও এনসিটিএফ বগুড়ার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন যেন তার সন্তানেরও নেতৃত্ব বিকাশে সহায়ক হতে পারে জাতীয় পর্যায়ের এই সংগঠনটি।

জেলা পর্যায়ে শিশুদের এই সংগঠনের সার্বিক কার্যক্রমের প্রশংসা করে জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বিপিএম বলেন, শিশুদের বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ পরিবার সর্বদাই অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে কাজ করে থাকে। সেখানে ইয়েস বাংলাদেশের তত্ত্বাবধানে বগুড়ায় এনসিটিএফ বগুড়ার শিশু নেতৃবৃন্দরা ইতিবাচক নানা লক্ষ্যকে সামনে রেখে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে তা প্রশংসার দাবিদার। তিনি বলেন, সম্প্রতি বগুড়ায় জেলা পুলিশের সাথেও এনসিটিএফ একটি সংলাপের আয়োজন করেছে সেখানে শিশুরা শুধু নিজেদের প্রেক্ষাপট থেকে নয় পুরো বগুড়ার শিশুদের মুখপাত্র হয়ে যেভাবে অধিকার নিয়ে কথা বলেছে  তার কাছে মনে হয়েছে তা নেতৃত্বের অনন্য এক উদাহরণ। এসপি সুদীপ চক্রবর্ত্তী শিশু নেতৃত্ব তৈরির ইতিবাচক এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান এবং শিশু অধিকার সম্পর্কিত সকল কাজে তিনি সর্বদা শিশুদের পাশে থেকে সহযোগিতারও প্রতিশ্রুতি দেন।