রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে চার বছর পূর্বে অপহরণপূর্বক আটক করে গৃহকর্মী হিসেবে নির্মম নির্যাতনের শিকার এক অসহায় পথশিশুকে উদ্ধার এবং অপহরণকারীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩।
র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সব ধরনের অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। র্যাব নিয়মিত জঙ্গী, সন্ত্রাসী, সংঘবদ্ধ অপরাধী, অস্ত্রধারী অপরাধী, মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ বিভিন্ন ধরনের অপহরণ হওয়া ভিকটিম উদ্ধার ও অপহরণকারীকে গ্রেফতারসহ চাঞ্চল্যকর অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের মনে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-৩, বিগত দিনগুলোতে অপহরণকারী আসামীদের বিরুদ্ধে ৩৭ টি অভিযান পরিচালনা করে ৩৭ জন ভিকটিম উদ্ধারসহ ৩৮ জন অপহরণকারী গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
২০১৮ সালে এক হতদরিদ্র দিনমজুরের কন্যা সন্তান জীবিকার তাগিদে রাস্তায় ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি শুরু করে। প্রতিদিনের মতো ভিকটিম ফুল বিক্রি করতে রাস্তায় যায় এবং দিন শেষে সে আর বাসায় আসেনি। মেয়েকে বাসায় আসতে না দেখে ভিকটিমের পিতা মাতা হন্যে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় তার সন্ধান করতে থাকে। তাদের চেনা জানা সকল জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর একপর্যায়ে ভিকটিমের বাবা মা তাদের সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে গুলশান থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরী করে। ডায়েরী করার ০৪ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও কোন খোঁজ না পেয়ে তারা র্যাব-৩ এ একটি অভিযোগ করে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং গুলশান থানায় নিখোঁজ ডায়েরীর ভিত্তিতে র্যাব-৩ ছায়া তদন্ত শুরু করে জানতে পারে যে, তাদের মেয়েকে অপহরণ করে গ্রেফতারকৃত আসামী নিজ বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে আটকে রেখে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করে আসছে।
উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল ১৯/১২/২০২২ তারিখ গভীর রাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চার বছর পূর্বে অপহরণপূর্বক আটককৃত এবং গৃহকর্মী হিসেবে নির্মম নির্যাতনের শিকার এক অসহায় পথশিশুকে উদ্ধার করে এবং সেই ঘৃণ্য অপরহণকারী ১। মোঃ আব্দুল্লাহ (৩৯), পিতা-মৃত নুরুল ইসলাম, বাসা নং-০৮, রোড-০৯, বøক এল, থানা-খিলগাঁও, জেলা-ঢাকাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
গ্রেফতারকৃত আসামী জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে গুলশান এলাকার আজাদ মসজিদের সামনে ফুটপাতে পথশিশু ভিকটিমকে ফুল ও কাগজের স্টীকার বিক্রি করা অবস্থায় দেখতে পায়। সেখান থেকেই অপহরণকারী তাকে টার্গেট করে এবং বেশ কয়েকদিন তাকে অনুসরণ করতে থাকে। এরপর একদিন বিকেলে ফুল বিক্রি করার সময় অপহরণকারী ভিকটিমকে ডেকে তার নাম জিজ্ঞেস করে এবং তার ছেঁড়া জামা কাপড় দেখে নতুন জামা কাপড় কিনে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ভিকটিম শিশুটিকে একটি মার্কেটে নিয়ে যায়। নতুন জামা কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনে দিয়ে ভিকটিমকে অপহরণকারী তার স্টীলের কারখানায় নিয়ে যায়। কারখানায় নিয়ে শিশুটিকে ৭/৮ দিন রাখার পর তাকে স্থানীয় এক দালালের কাছে গৃহ পরিচারিকা হিসেবে ২০,০০০ টাকার বিনিময়ে বিক্রির জন্য বায়নাপত্র করা হয়। কিন্তু কারখানায় থাকার ফলে খাবার এবং পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাবে শিশুটি অসুস্থ হয়ে গেলে তার অবস্থা দেখে উক্ত দালাল শিশুটিকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। শিশুটি অতিমাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহ শিশুটিকে তার নিজ বাসায় নিয়ে যায় এবং তাকে দিয়ে গৃহপরিচারিকার সকল কাজকর্ম করাতে থাকে। গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহ আরও জানায় যে, সে মূলত অর্থের লোভে শিশুটিকে চড়ামূল্যে বিক্রির আশায় অপহরণ করেছিল। কিন্তু আশানুরুপমূল্যে বিক্রি করতে না পারায় তার নিজ বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজে ভিকটিমকে নিয়োজিত করে।
ভিকটিমের জবানবন্দিতে জানা যায়, অপহরণের পর আটক থাকাকালীন শিশুটি বাবা মার কাছে যাওয়ার জন্য গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহর নিকট অনেক কাকুতি মিনতি করলেও তাতে কোন কাজ হয় না। যতদিন যায় শিশুটি তার বাবা মার কাছে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়তই কান্নাকাটি করে এবং তাদের বাসায় যারা নিয়মিত যাতায়াত করত তাদের অনেকের কাছেই শিশুটি তার বাবা মার বস্তির ঠিকানা দিয়ে সেই ঠিকানায় তাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করত। এসব দেখে গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহ এবং তার স্ত্রী শিশুটিকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। যখনই সে তার বাবা মায়ের নিকট ফিরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করত তার উপর অমানসিক নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে যেত। এভাবেই দুঃখ কষ্টে নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহর গৃহ পরিচারিকা হিসেবে ভিকটিম ০৪ বছর কাটিয়ে দেয়।
গ্রেফতারকৃত আব্দুল্লাহ ২০০২ সাল হতে খিলগাঁও এলাকায় স্টীলের ব্যবসায়ী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তার দুই সন্তান (০১ ছেলে ও ০১ মেয়ে) রয়েছে। সে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে এবং এরপর প্রথমে স্টীলের দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। পরবর্তীতে সে নিজস্ব একটি স্টীলের কারখানা প্রতিষ্ঠা করে স্টীলের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল।
উদ্ধারকৃত ভিকটিম ০৪ বছর পূর্বে অপহৃত হওয়ার সময় ১২ বছরের এক নাবালিকা শিশু ছিল। বর্তমানে তার বয়স ১৬ বছর। সে ১০ বছর বয়স থেকে গুলশানের বিভিন্ন রাস্তায় ফুল ও কাগজের স্টীকার বিক্রি করে বাবা মায়ের অভাব অনটনের সংসারে আর্থিকভাবে সহায়তা করত। ভিকটিমের বাবা সিটি কর্পোরেশনের পরিছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করত এবং বর্তমানে সে রিক্সা চালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে। ভিকটিমের মা গৃহকর্মী হিসেবে মানুষের বাসায় কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। ভিকটিমের দুই ভাই বোন রয়েছে যারা তার মতই রাস্তায় ফুল ও স্টীকার বিক্রি করে থাকে।
গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।