সাংবাদিকতার সাড়ে তিন যুগ -উনিশ


এবাদত আলী

  সংবাদ বলতে আমরা আমাদের চারপাশে যেসকল ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে তাকে বুঝে থাকি। শুধু ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। সে ঘটনাকে বিশেষ আঙ্গিকে সাজিয়ে তা যখন কোন পত্র-পত্রিকাতে প্রেরণ করা হয় এবং তা যদি পত্রিকার পাতায় প্রকাশ পায় তখন সে সংবাদ সত্যিকারে সংবাদ হয়ে দেখা দেয়। সংবাদ সে সংবাদই। তা বৈচিত্র পূর্ণই হোক আর বৈচিত্রহীনই হোকনা কেন। কোন কোন সংবাদ পাঠকগণের কাছে বৈচিত্র আনতে সক্ষম নয় হেতু তা অনেক সময় পাঠক সমাজ অবহেলার চোখে দেখে থাকেন। আবার কোন কোন ধরণের এমন কিছু সংবাদ আছে যা খবরের কাগজের পাঠকেরা লুফে নেন। সংবাদপত্রের ভাষায় এধরণের কিছু কিছু সংবাদকে হটকেক বলা হয়ে থাকে। 

এমনি একটি সংবাদ প্রকাশ পায় আটঘরিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকদের দ্বারা। ১৯৮০ সালের বিজয় দিবসের দিন জাতীয় পতাকা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে এক অনভিপ্রেত ঘটনার অবতারনা হয়। আর তাহলো আটঘরিয়ার সিও ডেভ কর্তৃক জাতীয় পতাকার অবমাননা। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য এদিন সুর্যোদয়ের সাথে সাথে সরকারি-বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনে জন্য আটঘরিয়া সার্কেল অফিসার ডেভেলপমেন্ট বা সিও ডেভ কর্তৃক আগের দিন বিকালে এলাকায় মাইক যোগে তা প্রচার করা হয়। জাতীয় পতাকার আকার আকৃতি ও পরিমাপ এবং তা কেমনভাবে উত্তোলন করতে হবে তাও জানানো হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত ছাড়াও বাসা-বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য তাগিদ প্রদান করা হয়। কোন দোকান-পাট কিংবা বাসাবাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তেলন না করলে জরিমানা করা হবে বলেও প্রচার করা হয়।
এদিকে আটঘরিয়া থানা সদর দেবোত্তরের একমাত্র চায়ের দোকানদার মজিবর রহমান ঠান্ডা বিজয় দিবসের সকালে যথারীতি তার চায়ের দোকানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। উত্তোলন বলতে একটি পাটখড়ির সঙ্গে জাতীয় পতাকা তার দোকানের টিনের চালায় ঝুলিয়ে রাখেন।
জাতীয় পতাকা সঠিকভাবে উত্তোলন হয়েছে কিনা তা দেখতে বের হন সি ও ডেভসহ থানা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তারা মজিবর রহমান ঠান্ডার চায়ের দোকানের নিকট এসে দেখেন জাতীয় পতাকা সঠিকভাবে উত্তোলন করা হয়নি।একটি পাটখড়ির সঙ্গে জাতীয় পতাকা ঝুলিয়ে রাখা অমার্জনীয় অপরাধ। তখন সিও ডেভ (নাম উল্লেখ করা হলোনা) রাগান্বিত হয়ে গালি-গালাজ শুরু করেন। এরা সব মুর্খের দল। এদের শস্তি হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি টিনের চালা থেকে পাটখড়িসহ জাতীয় পতাকা হ্যাচকা টানে নামিয়ে পাটখড়িটি টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলেন এবং জাতীয় পতাকা মাটিতে ফেলে দিয়ে দোকানদারকে গালি-গালাজ করতে করতে চলে যান। ধুলা মাটির মধ্যে জাতীয় পতাকা পড়ে থাকে।
আস্তে আস্তে ঘটনাটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মূল ঘটনার সাথে ডাল-পালার সৃষ্টি হয়। কথা রটনা হয় যে, আটঘরিয়ার দেবোত্তর থানা সদরের সিও সাহেব টাঙানো জাতীয় পতাকা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে তা খছেচেন এবং জাতীয় পতাকা উত্তেলনকারিদেরকে তিনি গালিগালাজ করেছেন।
স্থানীয় সাংবাদিকগণ এই খবর পত্রিকায় পত্র-পত্রিকায় পাঠায় এবং পরবর্তীকালে তা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ পায়। ‘‘পাবনার আটঘরিয়ার সিও ডেভ কর্তৃক জাতীয় পতাকার অবমাননা’’ শীর্ষক খবর ছাপা হলে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে পাবনা সদর এসডিও র উপর ঘটনা তদন্তের ভার দেওয়া হয়। এসডিও তদন্তে এলে স্থানীয় সাক্ষীগণ সিও ডেভ এর বদমেজাজের কথা জানান এবং জাতীয় পতাকার অবমাননার বিষয় অবগত করান। তাতে সিও সাহেবের চাকুরির ওপর দারুন হুমকি আসে। তিনি নিরুপায় হয়ে এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাহায্য কামনা করেন।
শুরু হয় দেন-দরবার। আটঘরিয়ার বেরুয়ান গ্রামের সাহাদত মাষ্টার (সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সমাজ পতি), খিদিরপুরের আরশেদ মাষ্টার, দেবোত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াহেদ খান, শ্রীকান্তপুর গ্রামের মোকছেদ বেপারি, ইসা খাঁ, উত্তর চকের আমিরখান, বরুরিয়ার আব্দুল আজিজ খান ও রাধাকান্তপুরের জাহাঙ্গির আলম ঘুঁটু প্রমুখ প্রধানবর্গ এ ঘটনার মধ্যস্থতা করেন।
তারা সিও ডেভ কে নিয়ে তার অফিসে বসে মিটিং করেন। কিন্তু ততক্ষণে এসডিও তার তদন্ত প্রতিবেদন ডিসি অফিসে জমা দিয়েছেন। এরপর এলাকার সমাজপতিগণ পাবনার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাত করে যা হবার হয়েছে তা যেন আর উপরে জানানো না হয় তার জন্য জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করেন। ফলে সে যাত্রায় সিও সাহেবের চাকুরি রক্ষা পায়।
(ক্রমশঃ) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী সাংবাদিক ও কলামিস্ট, সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব,