লালমনিরহাট প্রতিনিধি। সংস্কৃতির ঐতিহ্য খেলাধুলার ইতিহাস হাজার বছরের প্রাচীন ও পুরানো। গ্রামকে বলা হয় বাংলাদেশের হৃদপিণ্ড। এককালে লালমনিরহাট জেলার ৫টি (লালমনিরহাট সদর, আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা, পাটগ্রাম উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়ন ও ২টি (লালমনিরহাট, পাটগ্রাম) পৌরসভার প্রতিটি গ্রামে যেসব খেলাধুলা শিশু-যুবক-কিশোররা খেলতো হরদম, খেলাধুলার আবেশে মাতিয়ে রাখতো বাড়ির উঠোন, স্কুলের মাঠ, ফসল বিহীন ক্ষেত কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে দিনের পর দিন সে সব খেলাধুলা হারাতে বসেছে বাংলার পল্লীগ্রামের আনাচে-কানাচ থেকে। বিগত ক’বছর আগেও দেখা যেত গায়ের কিশোরীরা উঠোন দখল করে খেলছে সাত চারা, গোল্লাছুট, কানামাছি, বউছি, কুতকুত, মাছ-মাছ, বরফ-পানিসহ প্রভৃতি খেলাধুলা। আর খেলাধুলাতে কোনো কালেই কখনো পিছিয়ে থাকেনি বাঙালি ছেলেরা। বিশেষত গ্রাম্য ছেলেরা (কিশোর-যুবক)। তাদের খেলতে দেখা যেত দাড়িয়াবান্দা, হা-ডু-ডু, ফুটবল, ক্রিকেট গোল্লাছুট, ডাংগুলি, মারবেল, লুডু, ক্যারাম, দাবার মতো খেলা। লুডু খেলা, ষোল গুটি, তিন গুটির মতো বুদ্ধির খেলা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো বুড়োদের হাত ধরে। অবসর সময়ে কিংবা শীতকালে রোদ পোহাতে পোহাতে এসব খেলা খেলতো বুড়োরা। জমতোও ভালো। বর্ষাকালে খোলা মাঠে কিংবা ব্যস্তহীন রাস্তায় দেখা মিলতো কিশোরদের। কাদা মাটিতে হা-ডু-ডু কিংবা হাওয়াহীন ফুটবল খেলা জমতো সবচেয়ে বেশি। তবে খেলার চেয়ে কাঁদা মাখামাখি হতো উৎসাহজনক ভাবে। খেলোয়াড়রা যখন খেলা খুব কম থাকতো। সারা শরীরে কাদাতো লাগতোই, এমনকি মুখেও থাকতো। ঘরে ফিরে মায়েরা হয়তো একটু বকাবকি করতেন। খেলোয়াড়রা তা গায়ে না মেখে পরদিন একই চেহারা নিয়ে ঘরে ফিরত। বর্ষাকালে এই যাওয়া আসা হতো চিরন্তর। কিশোরদের থেকে যারা একটু ছোট তাদের ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা হতো একটু ভিন্ন ধরনের। কিশোরদের ফুটবলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ফুটবল না বলা গেলেও যারা তাদের চেয়ে একটু ছোট ছিলো তাদের ফুটবল কখনো কখনো ছিলো চালতার কড়ি। কখনো কখনো হতো গাছ থেকে ঝরে পড়া জাম্বুরা। খেলার উপকরণ যাই হোকনা কেনো, তাদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি। দাড়িয়াবান্দা ছিলো গ্রামের লোকজনের এক চমকপ্রদ খেলা। দাগের দুপাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতো উৎসুক মানুষ। উত্তেজনায় হৈ হুল্লোড়ও হতো প্রচুর। মারবেল আর ডাংগুলি খেলা হতো শরৎ শীত ও গ্রীষ্মকালে। গ্রামের বুড়োরা কেউ কেউ এই দুটো খেলাকে দেখতো খানিক বাজে খেলা হিসেবে। বিশেষত ডাংগুলি খেলাটা বিপদজনক বটে। কখন কার চোখে গিয়ে পড়ে সেই শঙ্কায় থাকতেন অভিভাবকরা। এসব খেলাগুলো অহরহ খেলতে দেখা গেলেও ডিজিটাল যুগে এসে সেই সব হারিয়ে গেছে গ্রাম্য খেলাগুলো। গ্রাম ছেড়ে ক্রমশ শহরমুখী মানুষ ক্রমশ ভুলে গেছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাগুলো।কানামাছি, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, মারবেল, দাঁড়িয়াবান্দার মতো শরীরের জন্য উপকারী খেলাগুলোর পরিবর্তে তাতে স্থান নিয়েছে ডিশ এন্টেনার টিভি চ্যানেল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ নানা ধরনের বিনোদন। শিশু-কিশোররা তাই আবদ্ধ হয়ে পড়েছে এসব বিনোদনে। শারীরিক শ্রমের মতো বিনোদনগুলো ঠাই পাচ্ছে না আধুনিক সমাজে। বিলুপ্তির প্রহর গুণছে যেন বাংলার গ্রামীণ খেলাধুলাগুলো। এর ফলশ্রুতিতে বর্তমান প্রজন্মের যেমন যথাযথ মানসিক বিকাশ ঘটছে না, অন্যদিকে ঘটছে স্বাস্থ্যহানি বাড়ছে রোগব্যাধির সংখ্যা। তাই নিজেদের ও সন্তানদের স্বার্থেই গ্রামীণ খেলাধুলাগুলোর ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা জরুরি। আগামী প্রজন্মের চোখে থাকুক মুক্ত আকাশ, নিঃশ্বাসে থাকুক বিশুদ্ধ বাতাস, বিনোদনে থাকুক এ হারাতে বসে যাওপড়াশুনা যেমন ছেলে-মেয়েদের মানসিক বিকাশ ঘটায় তেমনি শারীরিক বিকাশ ঘটাতে খেলাধুলার কোন বিকল্প নেই। আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে হা-ডু-ডু, কাবাডি ও লাঠিখেলার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা চলত। বিভিন্ন গ্রামে এসব খেলার জমজমাট আয়োজন হতো। এসব খেলা দেখার জন্য অনেক দুর দুরান্ত থেকে মানুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হতো খেলার মাঠে। অনেক খেলোয়াড় টাকার বিনিময়েও বিভিন্ন দলের হয়ে খেলতো। তাতে করে ভালো খেলে যেমন টাকাসহ নানারকম পুরস্কার মিলতো সেই সাথে ভালো খেলোয়াড় হিসাবে এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো তার খ্যাতি। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এ সমস্ত খেলোয়াড়দেরকে অনেক সম্মান করতো।
এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়ত অচিরেই গ্রামীণ খেলা-ধুলা আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। পরিণত হবে রূপকথার গল্পে। তবে এখনও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিলে হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলোর অনেকটাই টিকেয়ে রাখা সম্ভব। গ্রামীন খেলা-ধুলার সাথে রয়েছে আমাদের পূর্ব পূরুষদের সম্পর্ক। তাই তাদের স্মৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের উচিত এ সমস্ত খেলাধুলার আয়োজন করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর পরিচিতি ও তার সুফল লাভের জন্য আকৃষ্ট করা।