আজ ১০ ডিসেম্বর। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর এ দিবসটি উদযাপন করা হয়। জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা করে। ১৯৫০ সাল থেকে এই দিনটি উদযাপন করা হয়। মানবাধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও পৃথিবীর বহু মানুষ এ অধিকার থেকে বঞ্চিত। আজ এ নিবন্ধে পাবনার চাটমোহরের এমন একজন মায়ের কথা বলব যে মায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতি পদে পদে। এ মায়ের জন্য আমাদের কিছুই কি করণীয় নেই ?
পাবনার চাটমোহরের হরিপুর ইউনিয়নের চড়–ইকোল গ্রামের এক প্রতিবন্ধী মা রতœার দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে তার। তিন জনের এ পরিবারটি ভরণ পোষণ করার মতো কেউ না থাকায় দুটি সন্তান নিয়ে ছোট্র একটি টিনের ভাঙ্গা চোড়া ঝুপড়ি ঘরে দিন রাত কাটছে তার। দশ বছরের বড় মেয়েটা চেয়ে চিন্তে যা পায় তাতে কোন দিন এ বাড়িতে রান্নার হাড়ি জ্বলে কোন দিন জ্বলে না। স্বামী থেকে ও নেই। খোঁজ খবর নেয় না রতœা ও তার সন্তানদের। তাই বাধ্য হয়ে তৃতীয় সন্তান প্রসবের সময়েই সিজারের টাকার বিনিময়ে সন্তানটি দিয়ে দেন পাবনার রামচন্দ্রপুর এলাকার এক দম্পতিকে। এটি বছর দেড়েক আগের কথা। জাতীয় পরিচয় পত্র বা জন্ম সনদ না থাকায় সরকারী কোন সহায়তা পান না এ প্রতিবন্ধী মা। অর্থাভাবে চিকিৎসাও বন্ধ তার। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা কোনটিরই নিশ্চয়তা নাই এ পরিবারের।
সমাজের আর পাঁচটা মেয়ের মতই স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠে পাবনার চাটমোহরের হরিপুর ইউনিয়নের চড়–ইকোল গ্রামের খালেক মোল্লার মেয়ে রতœা (২৭)। বারো বছর আগে বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী ভাঙ্গুড়া উপজেলার ভাঙ্গুড়া কলেজপাড়ার মৃত তয়জাল ফকিরের ছেলে জাহিদুলের সাথে। জাহিদুল পেশায় একজন হকার। বিয়ের পর সাত-আট বছর শ্বশুড় বাড়িতেই বাস করেন রতœা। সেখানেই জন্ম নেয় বড় মেয়ে জাকিয়া (১০) ও মেজ মেয়ে যুথি (৫)। অলস প্রকৃতির স্বামী কখনো দেড় দুই মাস কখনো তার চেয়েও বেশি সময় বাড়ি আসেনা। খোঁজ খবর নেয় না স্ত্রী সন্তানদের। বাধ্য হয়ে যুথির জন্মের পর বাবার বাড়ি চলে আসে রতœা।
রতœার বাবা খালেক মোল্লা দ্বিতীয় বিয়ে করে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে একই গ্রামের অন্য পাড়ায় বাস করেন। রতœার মা অন্যের বাড়ি কাজ কর্ম করে সামান্য একটু জায়গা কিনে সেখানেই ঘর করে বসবাস করছেন এক ছেলেকে নিয়ে। ছেলের ও পৃথক সংসার। রতœাও মায়ের জায়গায় ঝুঁপড়ি তুলে আছেন। খালেক মোল্লা বা তার ছেলে শাহিন রতœা ও সাজেদার ধার ধারেন না। কয়েক বছর আগে হঠাৎ এক রাতে রতœার হাত পা অবশ হয়ে যায়। সেই থেকে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে সে। রতœার স্বামী জাহিদুল কালে ভদ্রে আসেন রতœার কাছে। রতœা জানান, “দুই মেয়ে নিয়ে যখন চলতে অক্ষম এমন সময় তৃতীয় সন্তান পেটে আসায় আমি আরো অসুস্থ্য হয়ে পরি। স্বামী ও আর খোঁজ নেয় না। সন্তানটি নষ্ট করে ফেলার জন্য অনেক চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। সন্তান প্রসবের সময় আমার খালা আমাকে পাবনার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সিজার করানোর মতো কোন টাকা ছিল না আমার হাতে। সন্তানটি তো খালাস করতে হবে। হাসপাতালের সবাইকে, যাকে কাছে পাই তাকেই বলি কেউ যদি আমার সিজারের টাকা দেয় তাকে আমি আমার সন্তানটি দিয়ে দেবো। এ খবর পেয়ে পাবনার রামচন্দ্রপুর এলাকার এক ব্যক্তি সিজারসহ আমার ডেলিভারীর সকল খরচ বহন করে। প্রসবের পরই কন্যা সন্তানটি সে নিয়ে যায়। আমি এক নজর দেখিও নি। সেই থেকে মায়ের বাড়িতেই ঝুঁপড়ি ঘরে কোনমতে বসবাস করছি। জাতীয় পরিচয় পত্র বা জন্মসনদ না থাকায় কোন প্রকার সরকারি সাহায্য সহযোগিতা পাই না আমি। আমি বাঁচতে চাই। মেয়ে দুটোকে বাঁচাতে চাই। দশ বছরের মেয়েটি দশ জনের কাছে হাত পেতে চেয়ে চিন্তে যা আনে তাতেই ক্ষুড়িয়ে ক্ষুড়িয়ে চলছে আমাদের। সরকারী বা বেসরকারী সহায়তা পেলে তবেই বাচ্চা দুটো নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো।” সমাজের বিত্তশালীদের নিকট ও তিনি সহায়তা চেয়েছেন।
ইউপি চেয়ারম্যান মকবুল হোসেনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারী সহায়তা পেতে জাতীয় পরিচয় পত্র প্রয়োজন। তার সেটি নেই। আমার নিকট ব্যক্তিগত সহায়তা চাইলে সেটি করা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিবন্ধী রতœার চলার ক্ষমতা নেই। নেই জাতীয় পরিচয় পত্র। চার টুকরো টিনের ভাঙ্গা ছাপরা ঘরে বসবাস তার। নেই রান্নার জায়গা। ঘরের সামনে চুলো বসানো। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে এখানেই এ পরিবারের রান্নার কাজ সারেন রতœার দশ বছরের মেয়ে জাকিয়া। এ পরিবারটির মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব কার ? লেখক- সাংবাদিক, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক।