এবাদত আলী
এমনি অবস্থার মধ্যে চলতে চলতে একদিন আটঘরিয়া থানার সার্কেল অফিসার (সি ও ডেভ) এ বি এম হাবিবুর রহমান হঠাৎ আমাকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পিয়ন মারফত খবর পাঠালেন। আমি তাঁর অফিসে গেলে এক ভদ্র লোকের সঙ্গে আমায় পরিচয় করিয়ে দিয়ে বল্লেন, ইনি রাজশাহী বরেন্দ্র মিউজিয়ামের প্রতœ তত্ব নিদর্শন সংগ্রাহক আব্দুস সামাদ মন্ডল। তাঁর সঙ্গে আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে সিও ডেভ একখানা চিঠি আমার হাতে দিয়ে বল্লেন ইনাকে আমার কাছে এইজন্য পাঠানো হয়েছে। গত ২৩/০৩/৭৯ তারিখের নং ডি আর এম/ ৪-৮/৪৫৫ নম্বর স্মারকের উক্ত চিঠিটি লিখেছেন মুখলেসুর রহমান এমএ পিএইচডি (লন্ডন) এফ আর এ এস। তিনি লিখেছেন, জনাব পত্রিকা মারফত জানা গেল পাবনা সদরের একটি গ্রামের একটি অট্রালিকার ধবংসাবশেষ হইতে গৌড়ের সুলতান আলউদ্দিন হুসেন শাহের সময়কার একটি শিলালীপি পাওয়া গিয়াছে। আরবী অক্ষরে উৎকীর্ণ ঐ শিলালিপির গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় গবেষণা ও সংরক্ষণের জন্য সেটি আমরা অত্র মিউজিয়ামে লইয়া আসিতে চাই। আপনি শিলালিপি প্রাপ্ত ব্যক্তিদের সম্মত করাইয়া উক্ত শিলালিপিটি অত্র মিউজিয়ামে দান করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করিলে বিশেষ বাধিত হইব। ৭০ বছর পূর্বে যে উদ্দেশ্যে এই মিউজিয়াম স্থাপিত হইয়াছিল তাহা সার্থক হইবে। আশা করি আপনার সাহয্য পাইব। পত্রের উত্তর আশা করি।’’ চিঠি পড়ার পর বিষয়টি আমার নিকট পরিষ্কার হয়ে গেলো। কারণ কয়েকদিন আগেই আমরা এ বিষয়ে নিউজ করেছিলাম। ঘটনাটি পাবনা সদর থানার মালিগাছা ইউনিয়নের বড় মাটিয়াবাড়ি গ্রামে।
বড় মাটিয়াবাড়ি গ্রামের ৪একর ৪৪ শতাংশ এলাকা জুড়ে বিশাল পুকুর বা দিঘী। এই দিঘীর পাড়েই ছিলো একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদের মেহরাবের নমুনা হিসেবে আরবী অক্ষরে পাথরে খোদাই করা একটি শিলালিপি কয়েকদিন আগে পাওয়া যায়। আর এই শিলালিপিকে কেন্দ্র করে নানা ধরণের কিংবদন্তী, গুজব ও আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। আমরা উক্ত শিলালিপির খবর বিভিন্ন পত্রিকাতে পাঠাই। তারই সুত্র ধরে আব্দুস সামাদ মন্ডলকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
আমি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে সাংবাদিক এইচকেএম আবু বকর সিদ্দিকের দোকান টেবুনিয়াতে যাই। সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম রাঙা, সাংবাদিক আব্দুল কুদ্দুস সাগর ও আরো দুএকজনকে খবর দেয়া হয়। আমরা সকলে মিলে সেই শিলালিপির উদ্দেশ্যে রওনা হই।
এলাকার জনসাধারণের নিকট হতে জানা যায়, বড়মাটিয়াবাড়ির দিঘির পাড় নামক স্থানটি বহু বছর যাবত ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিলো। বৃহৎ এই দিঘীতে ধাপ, দাম বা কচুরিপানা দ্বারা এমনভাবে পরিবেশ্টিত ছিলো যে, পাড়ে দাঁড়িয়ে কোথাও পানির লেশমাত্র চোখে পড়তোনা। কচুরিপানার উপর লতাগুল্ম পরিপূর্ণ ছিলো। গরু-মহিষ অবাধে তার উপর চড়ে কচুরি পানা ও লতাপাতা খেতো। মাত্র ক’বছর আগেও বড়মাটিয়াবাড়ি গ্রামটি জনশূন্য ছিলো। এমনকি আশেপাশে কোথাও বাড়ি-ঘর ছিলোনা। পরবর্তীকালে খন্দকার আশরাফ আলী নামক এক ব্যক্তি বসবাস শুরু করলে নতুন করে বসতি গড়ে ওঠে। এলাকার লোকজন কয়েক বছর ধরে পরিশ্রম করে দিঘিটি জঙ্গল মুক্ত করলেও তা একেবারে পরিষ্কার করা সম্ভব হয়না। তখনো পর্যন্ত কেউ দিঘির পানিতে গোসল করতোনা এবং গরু-ছাগলকেও পানি পান করাতোনা। কারণ এই দিঘিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের কিংবদন্তী ছিলো। এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে যে, বহু বছর আগে এই এলাকার এক হিন্দু রাজা, প্রজাদের পানির কষ্ট নিবারণের জন্য একটি বিরাটকায় দিঘি খনন করেন। দিঘির খনন কাজ শেষ হলেও তাতে বিন্দুমাত্র পানির চিহ্ন পাওয়া যায়না। উক্ত রাজা তখন জ্যোতিষি ডেকে পরামর্শ চাইলেন। জ্যোতিষি জানায় যে, যদি একজোড়া কচি শিশুকে বলি দেয়া যায় তবেই পানি উঠবে নচেৎ নয়। প্রতাপশালী রাজা সেই কাজই করলেন। একজোড়া শিশুকে পুকুরের মাঝখানে বলি দিতেই দিঘিটি পানিতে পরিপূর্ন হয়ে যায়। তাই গভীর রাতে নাকি ঐ দিঘির মাঝখান হতে কান্নকাটির করুন সুর ভেসে আসতো।
কেউ কেউ বলে থাকে বহুকাল আগে এলাকাটি মুসলমানদের দখলে ছিলো এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারের একটি প্রাণকেন্দ্র ছিলো। তখনই এখানে মসজিদ নির্মান করা হয়। পরবর্তীকালে দিঘী খনন কালে মসজিদটি মাটির নিচে চাপা পড়ে। কিংবদন্তী যাই থাকুক তার উপর নির্ভর না করে উক্ত দিঘির পাড়ের মাটির ঢিবির নিচে মসজিদের ধ্বংসাবশেষের মধ্য হতে যে শিলালিপিটি পাওয়া যায় সে সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলা যায় স্থানটির গুরুত্ব অপরিসীম। উক্ত দিঘির পাড়ে বসবাসরত লোকজন পাড়ের ঘন বন-জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে তারা পর পর দু’টি দালানের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পায়। দিঘির পাড়ে বসবাসকারি খন্দকার আশরাফ আলী ও আব্দুল কাদের মিয়া জানান পাথরে খোদাই করে আরবী হরফের লেখা পাঠোদ্ধারের কোন লোক এলাকায় পাওয়া যায়না।
অবশেষে পাথর খন্ডটি ধুয়ে মুছে তেলের প্রলেপ দিতেই হাজাল মসজিদ আরবী কয়েকটি অক্ষর বুঝা গেল।
প্রস্তর খন্ডের গায়ে আরবী হরফে যা লিপিবদ্ধ ছিলো তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।
‘‘হাজাল মসজিদ ফি আহদিস সুলতানিল আজমিল আদলে-হাফেজু বিলাদিল্লাহে নাছেরো- এবাদিল্লাহে গীয়াস উদ-দুনিয়া ওয়াদ্দিনে-আবু মোজাফ্ফর মাহমুদ শাহ বিন হুসাইন শাহ সুলতান খাল্লা দাল্লাহু-তায়ালা মূলকাহু ওয়া সুলতানাহু খায়রান জালিলুল মূলক বিন আফজালুল মূলক শাহরানে ছালাছিনা আরবাউ তেসআতুন। যার সংক্ষিপ্ত অর্থ হলো:- আরবী ৯৩৪ হিজরী সনে আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের পুত্র গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিলো।
অতীত ইতিহাস হতে জানা যায় গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের পুত্র সুলতান মাহমুদ শাহের সৈন্যসামন্তদের একটি ঘাঁটি ছিলো এখানে। সৈন্য সামন্তদের রসদপত্র ও মালামাল পরিবহন হতো নৌকা যোগে। তখন পদ্মা নদীর শাখা বাঙর নদী দিয়ে সওদাগরদের পন্যবাহী বড় বড় নৌকা এবং নবাব, সুলতান ও ইংরেজদের বিলাস বহুল পিনাস বা পানসি নৌকা দোঘুন্টি পাল তুলে অবাধে চলাচল করতো। আর এই নদীর পাড়েই ছিলো বড় মাটিয়াবাড়ি গ্রাম। এখান থেকে ভাটির দিকে বাঙড় নদী, বড়াল ও ধলাই নদীর সংযোগস্থল বাঘাবাড়ি হয়ে যমুনা নদীর সংযোগে মিলিত ছিলো। ফলে এই নদী পথে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে চলাচল ও পন্য পরিবহন খুবই সহজতর ছিলো।
যাক শিলা লীপির নির্ধারিত কোন অভিভাবক পাওয়া গেলনা। সকলেই যেন প্রধান। এলাকার লোকজন বলাবলি করে এটার দাম বহু টাকা। তা না হলে সেই রাজশাহী থেকে এটা নিতে এসেছে। মসজিদের একটি কমিটি আছে। কমিটির সভাপতি- সম্পাদক গ্রামবাসির কাছে অসহায়। গ্রামবাসির দাবি এই মুল্যবান পাথর নিতে হলে মসজিদ পাকা করে দিতে হবে।
(ক্রমশঃ) (লেখক:) সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব